
টরন্টোর চিঠি
এক রিকশায় দুজনের বেশি যাত্রী উঠতে পারবেন না এমন কোন নিয়ম কি জারি হয়েছে দেশে? বলতে পারছি না। তবে এবার ঢাকা সফরে পরিষ্কার করে বলতে পারি কোন রিকশায় দুজনের বেশি যাত্রী দেখিনি। সত্য বলতে কি যাত্রীসংখ্যা দুজন হওয়াই শ্রেয়, রিকশার মতো যানবাহনে তিনজন যাত্রী বসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রিকশা সার্বিকভাবেই একটি ঝুঁকিপূর্ণ যান। সেখানে তিনজন বসলে এটিতে দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
তবে বলতে কি আমি তো আর এখানে নীতিনির্ধারণী কোন আলোচনা করতে বসিনি। ভাবছিলাম আমার শৈশবের কথা, সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক ঢাকার হালহকিকত নিয়ে। আমি যখন নব্বই দশকের শেষভাগে নটর ডেম কলেজে পড়তাম তখন রিকশায় তিনজন বসা ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মূলত ভাড়া বাঁচানোর জন্যই মানুষ যতজন পারা যায় চেপে বসত একেকটা রিকশায়। এছাড়াও একই পরিবারের সব সদস্যের এক রিকশায় জেঁকে বসার ঘটনা দুর্লভ ছিল না। মনে আছে নটর ডেম কলেজে সপ্তাহের শেষদিনের ক্লাস শেষে মাঝে মাঝে আমাদের রিকশায় চড়ার শখ হতো।
মতিঝিল বা আরামবাগ থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্করে ভাড়া ছিল ২৫ টাকার মতো। তিনজন উঠলে টেনেটুনে ৩০ টাকা। মনে আছে অনেক দিন এভাবে রিকশায় চড়েছি আমি, রাজীব, ইয়াসিন। কখনও যাত্রী পাল্টে সওয়ার হতো রূপক কিংবা বকর। বকরকে অনেকে রুবেল নামেও চিনত, বিশেষত পরে যারা তার সঙ্গে বুয়েটে পরিচিত হয়। আরেফিন অর্থাৎ আমাদের টুটুলও যে দু-একদিন রিকশায় চেপে বসত না আমাদের সঙ্গে তা নয়। এখন যখন সেসব দিনের কথা চিন্তা করি তখন রৌদ্দুর কিংবা প্রচ- গরমে নাস্তানাবুদ হয়েছি কখনও এমনটা স্মৃতির পাতায় উঁকিঝুঁকি দেয় না পারতপক্ষে।
বরং মনে হয় মিষ্টি রোদে হাওয়া খেতে খেতে পরান জুড়িয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। তবে তিন নম্বর যাত্রীর জন্য যাত্রাটা সব সময় সুখকর হতো না। রিকশার বসার জায়গার পেছনের হাতলের সরু জায়গায় বসে একটা নায়ক নায়ক ভাব এলেও ঢাকার ভাঙাচোরা রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খুব একটা আনন্দ হতো এমনটা বলা যাবে না। তবু কেন জানি আমরা সবাই অন্যের ঘাড়ে চেপে ওপরের আসনে জায়গা নিতে চাইতাম। বয়সের ধাক্কা বোধ হয়। এখন এ কথা কস্মিনকালেও ভাবতে পারি না। যা বলছিলাম, এবার ঢাকায় গিয়ে কোন রিকশায় তিনজনকে একসঙ্গে বসতে দেখিনি।
ব্যাপারটা নিরাপদ হলেও এখন টরোন্টো এসে আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। এর কারণ কি হতে পারে? ঢাকায় কি রিকশা আরোহণে নতুন কোন নিয়ম আরোপিত হয়েছে যে, তিনজন যাত্রীকে একসঙ্গে বসতে দেখলে তাদের জেল-জরিমানা হতে পারে? নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের পক্ষে এখন এই সরু যানে তিনজন বসে সিদ্ধ হবার আর শখ নেই? নাকি মানুষের পকেটে আগের চাইতে অর্থের সংস্থান বেশি হয়েছে? দু’চার টাকা বাঁচানোর জন্য কেউ এখন আর একের ঘাড়ে অন্যে চড়ে বসতে রাজি নাই? নাকি আমাদের আর্থ-সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক বিবর্তনেরই একটি অংশ এটি?
হতেও পারে এটি নতুন দিনের ঢাকার পরিবর্তনের একটি অংশ। আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধির ব্যাপারটা একদম উড়িয়ে দিতে পারছি না। আমার বাবা সরকারের উপ-সচিব পদমর্যাদায় অবসর নেবার সময় তার ঢাকায় কোন গাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট ছিল না। সত্য বলতে কি তার জীবনের প্রথম গাড়ি কেনা হলো ৭৬ বছর বয়সে ২০২২ সালে এসে। আমরা ইউনিভার্সিটিতেও রিকশা চড়াকে ভাবতাম বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
কিছু টাকা হলেই ঘণ্টা ধরে বান্ধবীর সঙ্গে কিংবা বন্ধুকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে বেড়ানো ছিল এক ভীষণ আয়েশি আয়োজন। টাকা-পয়সা আরও কিছু উদ্ধার হলে ধানম-ি বা বেইলি রোডে ওয়েস্টার্ন গ্রিল কিংবা হেলভেসিয়ায় চিকেন ব্রেস্ট বা লেগ নামে মুরগির ঠ্যাং চিবানো ছিল চরম বড়লোকির লক্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছরে ইস্টার্ন প্লাজার পাশের একটি নতুন খোলা রেস্তরাঁয় নাসি গোরেং নামে এক মন মাতানো খাবার কেনার সৌভাগ্য হলো বিশেষ আয়োজনে।
ইন্দোনেশিয়ার খাবার নাসি গোরেং হচ্ছে মূলত ভেজিটেবল ফ্রায়েড রাইস, সঙ্গে আস্ত একটা ডিম পোচ উপর দিয়ে ছড়িয়ে দেয়া। দাম ছিল ৩০ টাকা। সঙ্গে কোল্ড ড্রিং নিলে দাম পড়ত আরও ৭ টাকা বোধ হয়। কোন বিশেষ দিনের জন্য অমন আয়োজন ভাবতে হতো। আরও কয়েক বছর পর হাতিরপুলের কাছে শর্মা হাউসের একটা দোকান খুলল। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর একটা বিফ শর্মা পাওয়া যেত বোধ হয় ৪০ টাকার মধ্যে। ওখানে খেতে গিয়ে একদিন দেখলাম লেখক আনিসুল হক, তার স্ত্রী মেরিনা ইয়াসমিন আর তাদের একমাত্র কন্যা পদ্মকে।
তখন আত্মসম্মানবোধ প্রবল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, পছন্দ করলেও এগিয়ে গিয়ে যে কথা বলব সেটা মাথায় আসেনি। আর তখনও মোবাইলের চল সীমিত, সেলফি তোলার যুগ আসেনি, মূলত অটোগ্রাফের শেষ সময় চলছিল। তাই দূর থেকে তাদের দেখেই চলে এসেছিলাম এখনও মনে আছে। যাই হোক, রিকশার আলাপ করতে করতে চলে আসলাম খাবার-দাবারে। আসলে খাবার ছাড়া আলাপ করার কিইবা আছে ঢাকাবাসীর। তবে টরন্টোর বিখ্যাত জেরার্ড স্ট্রিটে একটা সেরকম ঝাকানাকা রিকশার খোঁজ পাওয়া যাবে চোখ-কান খোলা রাখলেই। ১৩৬৫ জেরার্ড স্ট্রিট ইস্টে গেলে দেখা পাবেন বিখ্যাত পাকিস্তানী রেস্তরাঁ লাহোর টিক্কা হাউসের, যার ভেতরে খুব সুন্দর করে সাজানো একটা রঙচঙে রিকশা।
মানুষ খেতে এসে সেখানে দাঁড়িয়ে, বসে ছবি তোলে। বাইরে আছে আমাদের নব্বই দশকের ঐতিহ্য একটা বেবি ট্যাক্সিও। অদ্ভুত ব্যাপার, টরন্টোর পাকিস্তানী রেস্তরাঁর ভেতর পাওয়া যায় বাংলাদেশের গন্ধ, অথচ বাংলাদেশী কোন রেস্তরাঁয় এমন আয়োজন নেই।
টরন্টোতে লাখো বাংলাদেশী থাকলেও তাই আমি এটিকে এখনও বাংলাদেশীদের শক্ত ঘাঁটি মনে করি না। নিউইয়র্কে মুক্তধারার উদ্যোগে যে বাংলা বইমেলা হয় তাতে কেবল বাংলাদেশই নয়, উপমহাদেশের অনেক শক্তিশালী লেখক আসেন, সাহিত্যের নানা ধারা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। পাওয়া যায় প্রায় সকল প্রধান বাংলা বই। টরোন্টোতে প্রতিবছর একটা নামকাওয়াস্তে বাংলা বইমেলা হয় বটে; কিন্তু সেটিতে যেসব বই পাওয়া যায় তাতে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের কতটা উপকার হয় বলা মুশকিল।
তাও কবি আসাদ চৌধুরী টরোন্টোতে বাস করাতে রক্ষা। তাকে উপলক্ষ করে এখনও কিছু অনুষ্ঠান হয়, ভাল কিছু সাহিত্য রসদ পাওয়া যায়। যদিও টরন্টোতে অনেক ভাল কবি-সাহিত্যিক আছেন, তারা মূলত নিভৃতচারী হয়েই আছেন। শীতের পাখির মতো শীতের সাহিত্যিকদের ভিড়ে টরন্টোতে তাদের উপস্থিতি তেমন টের পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতি কিভাবে পাল্টাবে জানি না, কিন্তু আমার মনে হয়েছে ২০-৩০ বছর আগে যারা টরন্টোতে এসেছেন এখন তারা তাদের সেই প্রাচীন সার্কেলটিই ধরে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে তারা এখনও আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। ফলে বাংলাদেশীদের নিউইয়র্ক বা লন্ডনে যেই আধিপত্য বা নিজস্ব পরিচয় তৈরি হয়েছে কানাডায় এখনও তেমনটি হয়ে ওঠেনি। হয়ত সামনে বদলাবে, কে জানে!
পাঠকরা লেখাটি যখন পড়বেন তখন ১৭ আগস্ট, কিন্তু তবুও ১৫ অগাস্ট নিয়ে দুটো কথা না লিখলেই নয়। শোকাবহ ১৫ অগাস্টের কথা আমরা যতবার বলব ততবার বলতে হবে এই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনককে হত্যার পেছনে হাত ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রশ্রয়ে সামরিক বাহিনীতে উচ্চপদে আসীন হওয়া জিয়াউর রহমানের।
জিয়াউর রহমান শুধু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং ১৯৭১-এ যেসব সামরিক বাহিনীর সদস্য পাকিস্তানের পক্ষে ছিল বা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ না করে পাকিস্তানী সেনানিবাসে অবস্থান করেছিল তাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভাল ভাল পদে বসিয়েছেন। এদেরই একজন ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদও জিয়ার পদ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর খুনী ও পাকিস্তানপন্থী সেনা অফিসারদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পুরস্কৃত করেছেন।
শোকাবহ আগস্টের বহু বছর পর ১৯৯১ ও ২০০১ সালে দুই দফায় ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি, যারা ১৯৭১ সালে বাংলার মাটিতে বসে মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে সেসব বাহিনীর নেতাদের মন্ত্রী বানিয়েছেন, এমপি বানিয়েছেন, সংসদে বসিয়েছেন। তাদের বাড়িতে-গাড়িতে-অফিসে বাংলাদেশের পতাকা দিয়েছেন। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক জিয়া বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে, বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে এখন লন্ডনে পলাতক আছে।
খুনী জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াও দুর্নীতির দায়ে দ-াদেশপ্রাপ্ত হয়ে কারাভোগ করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার বয়স বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে জেল থেকে বাইরে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অথচ খালেদা জিয়ার স্বামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করেছেন। তার ছেলে হত্যা করার চেষ্টা করেছে স্বয়ং শেখ হাসিনাকে।
যতবার ১৫ অগাস্টের শোকাবহ দিনের কথা আমরা স্মরণ করব ততবার আমাদের মনে করতে হবে এর পেছনে জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী সেনা সদস্যদের বেইমানির কথা। আমরা যদি জাতির জনকের হত্যাকারীদের ভুলে যাই তাহলে এই শোক দিবস থেকে আমরা কোন শিক্ষা নিতে পারব না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে, আদালতের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু হত্যাকারীর বিচার কার্যকর করতে পেরেছেন।
অথচ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ায় এক সময় বলা হচ্ছিল তিনি বাবার হত্যার বিচার নিয়ে নাকি রাজনীতি করছেন। কারণ তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় গায়ের জোরে আদালতের বিচারকার্যকে প্রভাবিত করেননি। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং পরবর্তীতে ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কেবল অর্থনৈতিক মুক্তিই দেননি, বরং জাতির জনকের হত্যার বিচার করেছেন, ১৯৭১ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন।
সেনাবাহিনীসহ নানা বাহিনী থেকে পাকিস্তানপন্থী-জামায়াতপন্থী আগাছাও পরিষ্কার করেছেন। শোকাবহ আগস্ট মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার জন্য। ধন্যবাদ জানাই শেখ হাসিনার মতো একজন উত্তরাধিকার রেখে যাবার জন্য, যাকে ছাড়া বাংলাদেশ সোনার বাংলা হতো না, হয়ে যেত পাকিস্তানের ধসে যাওয়া একটি প্রেতাত্মা মাত্র।
১৫ আগস্ট ২০২২
টরন্টো, কানাডা