এক হালি ফার্মের ডিম কিনতে লাগছে ৫৫-৬০ টাকা
এক মন্ত্রী বললেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি। মানে তিনি বলতে চেয়েছেন বিশ^মন্দায় আমরা বাংলাদেশীরা সুখে আছি, ভাল আছি। মূল্যস্ফীতি ও সংসারের ব্যয় সামলাতে কষ্টের মধ্যে থেকে এ ধরনের কথাবার্তায় মানুষের কেমন প্রতিক্রিয়া হবে? একজন টিপ্পনি কেটে বললেন, মৃত্যুর পরেই না আসবে বেহেশত-দোজখের প্রশ্ন। তার মানে কি আমরা ইতোমধ্যে অর্থচাপে মারা পড়েছি? ভাগ্যিস আরেক মন্ত্রী একদিন পরেই বললেন, সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, এটি অস্বীকার করার কিছু নেই। হক কথা।
এটি শুনে ওই লোকটি আবার তীর্যক মন্তব্য ছুঁড়লেন। বললেন, সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, আর অসাধারণ মানুষ (ধনী আর মন্ত্রী-আমলাদেরই বুঝিয়েছেন তিনি) বেহেশতে আছে। বঙ্গদেশের মানুষের মন বড়ই রঙ্গে ভরা। নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও তারা রসিকতা করতে ছাড়ে না।
বিদ্যুত ও পানি সমাচার
রবিবার কলামটি লিখতে বসার আগে দেখেছি যে আজ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় তিন ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে। জ¦ালানি-সংকটে প্রথম প্রথম বলা হয়েছিল এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে। যা হোক, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) আওতাধীন এলাকাগুলোয় তিন ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের রুটিনও দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের আগেভাগে জানানোর এই উদ্যোগ ভাল। মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারে। বেশি কষ্ট তো এসি-ফ্যান বন্ধ থাকা। অবশ্য আজ ঢাকাকে শ্রাবণ মাসেরই একটি দিন বলে মনে হচ্ছে। দুপুর থেকে বেশ ভালই বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বৃষ্টি মানে আবার জলাবদ্ধতার শঙ্কা। (অবশ্য সন্ধ্যার পর-পর এক ঢাকাবাসী ফেসবুক পোস্টে লিখলেন- আজ ৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার কথা। একবারও যায়নি, শুধু ১৫ মিনিটের বিরতি ছিল, টেনশনে আছি ...)
বিদ্যুত না হয় দুই তিন ঘণ্টা না থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। কিন্তু পানির সরবরাহ যদি বেশ কমে যায় তাহলে নাগরিকদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এখন আবার ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রায়ের বাজার, আগারগাঁও, কালাচাঁদপুর পশ্চিম এলাকা, মিরপুর, বারিধারার নুরের চালা, ভাটারা, কুড়িল বিশ্বরোডসহ বিভিন্ন এলাকায় রীতিমতো পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে নতুন করে এ সপ্তাহে যোগ হয়েছে গুলশান, আফতাবনগর ও মহাখালী এলাকা।
ওয়াসা কর্মকর্তারা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বৃষ্টিপাত কম, জনসংখ্যা ও চাহিদা বাড়ার কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামছে। এজন্য প্রায় ১০০-এর বেশি পানির পাম্প বিকল হয়ে পড়েছে। এছাড়া লোডশোডিংয়ের কারণেও পানির উৎপাদন ও সরবরাহ কমেছে। পাশাপাশি নতুন পাম্প বসানোরও জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রেশনিং করেই চলতে হচ্ছে।
বুঝুন অবস্থা। আগামী দিনগুলোয় যে কী হবে ঢাকাবাসীর?
হন্তারক ছিনতাইকারী
ছিনতাই ঢাকার প্রতিদিনকার ঘটনা হলেও বছরে এক-দুবার এ কলামে প্রসঙ্গটি আসে। কেননা একই জিনিস লিখতে যেমন লেখকের ভাল লাগে না, তেমনি পাঠকেরও পড়তে বিরক্তি আসে। লাখ লাখ মানুষ একবারের জন্য হলেও ছিনতাইয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন ঢাকায় থাকার সুবাদে। যাহোক, ছিনতাইকারী নিয়ে এবার সামান্য লিখতেই হচ্ছে, কেননা বিষয়টি মারাত্মক। বুথ থেকে টাকা তুলে গোনার সময় ছিনতাইকারীর হাতে ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার খবরটি এটিএম বুথ ব্যবহারকারী ঢাকাবাসীকে কমবেশি শঙ্কিত করে তুলবে, এটি স্বাভাবিক। আমার এলাকা উত্তরায় এ ঘটনা ঘটে সেদিন।
মধ্যরাতে একটি বেসরকারী ব্যাংকের এটিএম বুথে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে শরিফ উল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। তিনি টাইলসের ব্যবসা করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। থাকতেন টঙ্গী। ছুরিকাঘাত করে পালানোর সময় ছিনতাইকারী সামাদকে আটক করেন স্থানীয় লোকজন। এই প্রতিরোধ গড়ে তোলার দরকারি বিষয়টিই লক্ষ্য করার মতো। এটিএম বুথে ঢুকে উত্তোলনকৃত টাকা ছিনিয়ে নেওয়া খুবই উদ্বেগজনক। বুথের প্রহরী যদি প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন তবে রাতবিরেতে লোকে টাকা তুলবে কিভাবে? সাধারণত প্রধান সড়কগুলোর ওপরেই থাকে এই বুথগুলো। তাই টহল পুলিশের তৎপরতা বাড়ানোর কথাই বলব আমরা।
সীমিত আয় বাড়তি খরচ
দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ইতোমধ্যে ডিমের দাম রেকর্ড গড়েছে। এক হালি ফার্মের ডিম কিনতে লাগছে ৫৫-৬০ টাকা। যাদের বড় মাছ কিংবা মাংস কেনার সামর্থ্য খুবই কম তারা আমিষের প্রয়োজন মেটান এই ডিম খেয়ে। সংসারে প্রতিদিন যদি এক হালি ডিম লাগে তাহলে চলতি মাসে ওই পরিবারের ব্যয় শুধু ডিম কেনাতেই বেড়ে গেল ৫০০ থেকে হাজার টাকা। সবজির দামও বাড়তি।
ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েছে। কিন্তু বাড়তি টাকা আয়ের পথ কি মানুষের সামনে খোলা আছে? সাধারণ মানুষের আয় বাড়ে না সারা বছরেও। অথচ ঋতুতে ঋতুতে খরচ বেড়ে চলে। চলতি আগস্ট মাসে মানুষের ব্যয়ের সামর্থ্য কমবে। তাকে আয়-ব্যয়ের সমন্বয় সাধন করতে হলে কেনাকাটা কমিয়ে দিতেই হবে, কোনো উপায় নেই।
এ মাসেই অফিস যাত্রীদের প্রতিদিনের বাসভাড়া বেড়ে গেছে যাওয়া-আসা মিলিয়ে কমপক্ষে কুড়ি টাকা। মাসে বাড়তি ৫০০ টাকা। ঢাকার মাস এনে মাস খাওয়া মানুষ লাখ লাখ; তারা এই বাড়তি ব্যয়ের চাপ কিভাবে সামলাবেন? তার ওপর আমরা দেখতে পাচ্ছি এবার জ্বালানি তেলের মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এর চেয়ে বেশি হারে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এরপরও পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা বাড়তি ভাড়ায় আদায় চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে জনগণকে জিম্মি করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই, প্রতিদিনই করছেন।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় রোধে কঠোর হওয়ার নির্দেশনা আসে। নগর ও শহরতলির বাস-মিনিবাসে ওয়েবিল প্রথা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এই ব্যবস্থায় একটি রুটে সাধারণত নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় বাসমালিকের লোকেরা এই পরিদর্শন বা চেক করেন। তারা নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামিয়ে কতজন যাত্রী আছে তা লিখে দেন। এর ফলে একজন যাত্রীকে বাসে উঠে পরের স্ট্যান্ডে নেমে গেলেও পরবর্তী ওয়েবিল লেখার স্থান পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। এভাবে সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বাড়তি আদায় করে থাকেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। এ ছাড়া সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিসের নামেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়।
সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, ওয়েবিল প্রথা, সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস অবৈধ। বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির চলাচলের অনুমতি বাতিল করার বিধান আছে। কিন্তু সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় আইনের এই কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ করে না। ঘোষণা দিয়েই ওয়েবিল প্রথা বন্ধ করার কথা বলেছে পরিবহন মালিকদের সংগঠন। আবার তারাই ক্ষেত্রবিশেষে এটা মানছেন না। প্রকৃত দূরত্ব গোপন করে বেশি দূরত্ব দেখিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় চলছেই। সাধারণ মানুষের ধারণা তাদের ওপর এই মহাঅন্যায় দেখার কেউ নেই। তারা সত্যিই জিম্মি।
বাসে শিশুশ্রম
ভিডিওটি দেখেছি এক ফেসবুক বন্ধুর বরাতে। তিনি নিজেই এটি তুলেছেন এবং লিখেছেন। আমাদের ঢাকার এ আরেক চেহারা। আরেক বাস্তবতা। লেখা হয়েছে : ‘বাসে উঠতেই চোখ পড়ল দরজা ঘেঁষে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম কারও বাচ্চা হয়তো। ডেকে বললাম এই তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন, পড়ে যাবা তো। লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, সে পড়বে না। তখন পাশ থেকে আরেক যাত্রী বলে উঠল- পড়বে না, ওর সব চেনা। এ বাসের হেলপার সে।
এটা শুনে পুরা থ হয়ে গেলাম। পাঁচ-ছয় বছরের একটা বাচ্চা বাসের হেলপার, তাও বিশাল সাইজের বিআরটিসি বাসের, এটাও কি সম্ভব? যে বয়সে ছেলেটার প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ানোর কথা, মায়ের কোলে থাকার কথা, সে বাচ্চাটা জীবনের লড়াইয়ে নেমে গেছে। জীবন মানুষকে কখন কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় কেউ জানে না। ছেলেটার জন্য মায়া দেখানো ছাড়া আমার করার কিছু ছিল না।’
অর্থলোভে অমানুষ
খবরটি জুন মাসের, কিন্তু আমরা জানলাম দেড় মাস পরে। রবিবার এ খবর পড়ে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে থাকি। বৃদ্ধ বাবার ৩১ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিতে ছিনতাইকারীর সঙ্গে আঁতাত করে তার ছেলেরা! বৃদ্ধ জয়নাল মিয়া ও তার স্ত্রী হনুফা বেগমকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের তিন ছেলে। এরপর জয়নাল মিয়া তার বসতবাড়ির দুই কাঠা জমি ৩১ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। বাবার জমি বিক্রির সেই টাকা ছিনিয়ে নিতে জয়নাল মিয়ার তিন ছেলে হাত মেলান ছিনতাইকারীর সঙ্গে।
গত ২৮ জুন জয়নাল মিয়া বসতভিটার জমি বিক্রি করেন। জমি বিক্রির টাকা ব্যাগে নিয়ে রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেলে বাসায় ফিরছিলেন। একপর্যায়ে মানিকদীতে বাসার কাছে পৌঁছালে আবদুল হানিফ তার অপর দুই ভাইকে নিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে বসা জয়নালকে লোহার রড দিয়ে আঘাত করলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। ছিনতাইকারী জয়নাল মিয়াকে কুপিয়ে তার কাছ থেকে ৩১ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন।
ক্যান্টনমেন্ট থানার মানিকদী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় জয়নালকে তার জামাতা রক্ষা করতে এলে পিটিয়ে তার পা ভেঙে দেয়া হয়। একপর্যায়ে বৃদ্ধ মা এগিয়ে এলে তাকেও বেধড়ক পেটান সন্তানরা। জয়নাল মিয়ার টাকা ছিনিয়ে নিতে তার তিন ছেলে ছিনতাইকারী সোহেলসহ দুজনের সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন। অপর ছিনতাইকারীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
সৎ ছেলে হলে না হয় একটা যুক্তি মিলত। নিজের ছেলেরা কিভাবে এমন অমানুষিক কা- করতে পারে! এরা কুলাঙ্গার সন্দেহ নেই। ওই তিন ‘গুণধর’ পুত্রের স্ত্রীরাও নাকি সমর্থন দাত্রী। কে কার সঙ্গদোষে এমন অমানুষ হলো?
মেয়রের মর্যাদা
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন আইনে মেয়রদের পদমর্যাদা বিষয়ে কিছু বলা নেই। তবে ঢাকার মেয়রের মন্ত্রীর পদমর্যাদা লাভ নতুন নয়। এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকার মেয়র হিসেবে নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে প্রথম প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আমলের দুই মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও মোহাম্মদ হানিফ পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন।
তৎকালীন সরকার এক নির্বাহী আদেশে তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করে। ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার পর মন্ত্রীর পদমর্যাদা পাওয়ার বিষয়টি কিছুকাল ঝুলে ছিল। পরে অবশ্য আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন মন্ত্রীর পদমর্যাদা পান।
ঢাকার বর্তমান দুই মেয়র ওই বিশেষ পদমর্যাদা লাভের পর কাজেকর্মে আরও সক্রিয় ও আন্তরিক হবেন, ঢাকাবাসী এমনটা আশা করতেই পারেন।
১৪ আগস্ট ২০২২