ইসলাম প্রসঙ্গে
গত শুক্রবার আমরা এ কলামে শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইনের মহীয়সী মা হযরত ফাতিমাতুজ জোহরা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজ তারই ধারাবাহিকতায় আরও কিছু কথা। হযরত ফাতিমা একজন মহিলা হিসেবে, একজন গৃহকর্ত্রী হিসেবে, একজন মা হিসেবে আমাদের সকলের আদর্শ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ আমাদের সমাজে ফাতিমা, জোহরা নামের সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে মা ফাতিমার আদর্শের নারী সমাজ।
ইসলামের ইতিহাসের অনেক ঘটনার সঙ্গে মা ফাতিমার ভূমিকা জড়িত। যে রাতে রাসূল (সা.) মদীনায় হিজরত করলেন সে রাতে আলী (রা.) যে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন, ফাতিমা (রা.) অতি নিকট থেকে তা প্রত্যক্ষ করেন। আলী (রা.) নিজের জীবন বাজি রেখে কুরাইশ পাষ-দের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) এর বিছানায় শুয়ে থাকেন। সেই ভয়াবহ রাতে ফাতিমাও বাড়িতে ছিলেন। অত্যন্ত নির্ভীকভাবে কুরাইশদের সব চাপ প্রত্যাখ্যান করেন।
রাসূল (সা.) মদীনায় একটু স্থির হওয়ার পর হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পরে আলী (রা.) এর সঙ্গে ফাতিমা (রা.) এর বিয়ে হয়। একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) হযরত আয়িশাকে (রা.) ঘরে উঠিয়ে নেয়ার চার মাস পরে আলী ফাতিমা (রা.) এর বিয়ে হয় এবং বিয়ের নয় মাস পরে তাদের বাসর হয়। বিয়ের সময় ফাতিমা (রা.) এর বয়স পনেরো বছর সাড়ে পাঁচ মাস এবং আলীর বয়স একুশ বছর পাঁচ মাস।
ফাতিমা (রা.) এর সঙ্গে কিভাবে বিয়ে হয়েছিল সে সম্পর্কে আলী (রা.) এর বর্ণনা এ রকম: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট ফাতিমার বিয়ের পয়গাম এলো। তখন আমার এক দাসী আমাকে বললেন: আপনি কি একথা জানেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট ফাতিমার বিয়ের পয়গাম এসেছে? বললাম: না। সে বলল: হাঁ পয়গাম এসেছে। আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট কেন যাচ্ছেন না? আপনি গেলে রাসূলুল্লাহ (সা.) আপনার সঙ্গে ফাতিমাকে বিয়ে দেবেন। বললাম: বিয়ে করার মতো আমার কিছু আছে কি? সে বলল: যদি আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে যান, তাহলে তিনি অবশ্যই আপনার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেবেন।
আলী (রা.) বললেন : আল্লাহর কসম! সে আমাকে এভাবে আশা ভরসা দিতে থাকে। অবশেষে আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে গেলাম। তাঁর সামনে বসার পর আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। তাঁর মহত্ত্ব ও তাঁর মধ্যে বিরাজমান গাম্ভীর্য ও ভীতির ভাবের কারণেই আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। এক সময় তিনিই আমাকে প্রশ্ন করলেন: কি জন্য এসেছ? কোন প্রয়োজন আছে কি? আলী (রা.) বলেন: আমি চুপ করে থাকলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, নিশ্চয় ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছ? আম বললাম: হ্যাঁ। তিনি বললেন: তোমার কাছে এমন কিছু আছে কি যা দ্বারা তুমি তাঁকে হালাল করবে? বললাম: আল্লাহর কসম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নেই। তিনি বললেন: তিনি বললেন, যে বর্মটি আমি তোমাকে দিয়েছিলাম সেটা কি করেছ? বললাম, সেটা আমার কাছে আছে।
আলীর জীবন যে সত্তার হাতে তাঁর কসম, সেটা তো ‘হুতামী’ বর্ম। তার দাম চার দিরহামও হবে না। রাসূলুল্লাহ বললেন, আমি তারই বিনিময়ে ফাতিমাকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিলাম। সেটা তাঁর কাছে পাঠিয়ে দাও এবং তা দ্বারা তাঁকে হালাল করে নাও। আলী (রা.) বলেন: এই ছিল ফাতিমা বিনতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মহর। আলী (রা.) খুব দ্রুত বাড়ি গিয়ে বর্মটি নিয়ে আসেন। কনেকে সাজগোজের জিনিসপত্র কেনার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) সেটি বিক্রি করতে বললেন। বর্মটি হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) চারশত সত্তর (৪৭০) দিরহামে কেনেন। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে রাসূল (সা.) সাহাবীদের ডেকে পাঠান। তারা উপস্থিত হলে তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি তাঁর মেয়ে ফাতিমাকে চারশ’ মিছকাল রূপার বিনিময়ে আলীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। তারপর আরবের প্রথা অনুযায়ী কনের পক্ষ থেকে রাসূল (সা.) ও বর আলী (রা.) নিজে সংক্ষিপ্ত খুতবা দান করেন। তারপর উপস্থিত অতিথি সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে খোরমা ভর্তি একটা পাত্র উপস্থাপন করা হয়।
এভাবে অতি সাধারণ ও সাদাসিধেভাবে আলীর সঙ্গে নবী দুহিতা ফাতিমাতুজ জোহরার শাদি মুবারক সম্পন্ন হয়। অন্য কথায় ইসলামের দীর্ঘ ইতহাসের সবচেয়ে মহান ও গৌরবময় বৈবাহিক সম্পর্কটি স্থাপিত হয়।
মদীনায় আসার পর রজব মাসে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আর হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর আলী (রা.) তাঁর স্ত্রীকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য একটি ঘর ভাড়া করতে সক্ষম হন। বানু আবদিল মুত্তালিব এই বিয়ে উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ এমন একটা ভোজ অনুষ্ঠান করেছিলেন যে, তেমন অনুষ্ঠান নাকি এর আগে তারা আর করেননি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে হযরত উম্মে সালমা কনেকে নিয়ে বরের বাড়িতে যান।
ঈশার নামাযের পর দাফতরিক ঝামেলামুক্ত হয়ে নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আলী (রা.) এর বাড়ি গেলেন। আলাপচারিতার ফাঁকে তিনি একটু পানি আনতে বললেন। পানি আনা হলে কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে তাতে ফুঁক দিলেন। সেই পানির কিছু বর-কনেকে পান করাতে বললেন। অবশিষ্ট পানি দিয়ে রাসূল (সা.) নিচে ধরে রাখা একটি পাত্রের মধ্যে অজু করলেন। সেই পানি তাদের দুজনের মাথায় ছিটিয়ে দিলেন।
তারপর এই দু’আ করতে করতে যাওয়ার জন্য উঠলেন: ‘আল্লাহুম্মা বারিক ফীহিমা ওয়া বারিক আলাইহিমা ওয়া বারিক লাহুমা ফি নাসালিহিমা- হে আল্লাহ ! তুমি তাদের দুজনের মধ্যে বরকত দান কর। হে আল্লাহ! তুমি তাদের দুজনকে কল্যাণ দান কর। হে আল্লাহ! তাদের বংশধারায় সমৃদ্ধি দান কর।’
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, যাবার সময় তিনি মেয়েকে লক্ষ্য করে বলেন: ফাতিমা! তুমি মন খারাপ করবে না, তুমি বিশ্বাস রাখবে আমি আল্লাহ পাকেরই নির্দেশে ও ইশারায় আমার পরিবারের সবচেয়ে ভাল সদস্যের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেয়ার বিষয়ে কোন ত্রুটি করিনি।
এর আগে ফাতিমা মনে হয় বর দরিদ্র হওয়ার কারণে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। জবাবে হযরত বলেছিলেন: মা, সে দুনিয়াতে একজন নেতা এবং আখিরাতেও সে সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হবে। সাহাবীদের মধ্যে তার জ্ঞান বেশি। সে একজন বিচক্ষণও। তাছাড়া সবার আগে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।- (তাবাকাত ৮/১৫,২৮: তারাযিমু সাইয়েদাতি বাইত আন নবুয়াহ -৬০৮)।
পিতৃগৃহ থেকে ফাতিমা যে স্বামী গৃহে যান সেখানে কোন প্রাচুর্য ছিল না। বরং সেখানে যা ছিল তাকে দারিদ্র্যের কঠোর বাস্তবতাই বলা সঙ্গত। সে ক্ষেত্রে তাঁর অন্য বোনদের স্বামীদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক অনেক ভাল ছিল। যায়নাবের বিয়ে হয় আবুল আ’স (রা.) এর সঙ্গে। তিনি মক্কার অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলেন। রুকাইয়্যা ও উম্মে কুলসুমের বিয়ে হয় উসমান ইবন ‘আফ্ফান (রা.) এর সঙ্গে। আর উসমান ছিলেন একজন বিত্তবান ব্যক্তি। তাঁদের তুলনায় আলী (রা.) ছিলেন একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষ। তাঁর পিতা মক্কার সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন।
তবে তেমন অর্থ-বিত্তের মালিক ছিলেন না। তার সন্তান ছিল অনেক। তাই বোঝা লাঘবের জন্য মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর চাচা আব্বাস তাঁর দুই ছেলের লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন। এভাবে আলী (রা.) যুক্ত হয়েছিলেন মুহাম্মদ (সা.) এর পরিবারের সঙ্গে।
ফাতিমা স্বামীর ঘরে গিয়ে পেলেন খেজুর গাছের ছাল ভর্তি চামড়ার বালিশ, বিছানা, এক জোড়া যাঁতা, দুটো মশক, দুটো পানির ঘড়া, আর আতর-সুগন্ধি। স্বামী দারিদ্র্যের কারণে ঘর গৃহস্থালীর কাজ-কর্মে তাঁকে সহায়তা করার জন্য অথবা অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজগুলো করার জন্য কোন চাকর-চাকরানী দিতে পারেননি। ফাতিমা (রা.) একাই সব ধরনের কাজ সম্পাদন করতেন। যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে যায়, মশক ভর্তি পানি টানতে টানতে বুকে দাগ হয়ে যায় এবং ঘরবাড়ি ঝাড়– দিতে দিতে পরিহিত কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যেত। তাঁর এভাবে কাজ করা আলী (রা.) মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর করারও কিছু ছিল না। যতটুকু পারতেন নিজে তাঁর কাজে সাহায্য করতেন। তিনি সব সময় ফাতিমা (রা.) এর স্বাস্থ্যের বিষয়ে সতর্ক থাকতেন।
এসময় ফাতিমার পিতা রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও যুদ্ধবন্দীসহ বিজয়ীর বেশে একটি যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফিরলেন। আলী (রা.) একদিন বললেন : ফাতিমা! তোমার এমন কষ্ট দেখে আমার বড় দুঃখ হয়। আল্লাহ তায়ালা অনেক যুদ্ধবন্দী দিয়েছেন। তুমি যদি তোমার পিতার কছে গিয়ে তোমার সেবার জন্য যুদ্ধবন্দী একটি দাসের জন্য আবেদন জানাতে! ফাতিমা ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় হাতের যাঁতা পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলেন: আমি যাব ইনশাআল্লাহ। তারপর বাড়ির আঙিনায় একটু বিশ্রাম নিয়ে চাদর দিয়ে গা-মাথা ঢেকে ধীর পায়ে পিতৃগৃহের দিকে বেরিয়ে গেলেন।
পিতা তাঁকে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন : মেয়ে ! কেন এসেছ? ফাতিমা বললেন: আপনাকে সালাম করতে এসেছি। তিনি লজ্জায় পিতাকে মনের কথাটি বলতে পারলেন না। বাড়ি ফিরে এলেন এবং স্বামীকে সে কথা বললেন। আলী (রা.) এবার ফাতিমাকে সঙ্গে করে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট গেলেন। ফাতিমা পিতার সামনে লজ্জায় মুখ নিচু করে নিজের প্রয়োজনের কথাটি এবার বলে ফেলেন। পিতা তাঁকে বলেন: মাগো,আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে আমি একটি দাসও দিতে পারছি না। গরিব নিঃস্ব আহলুস সুফ্ফার লোকেরা না খেয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে। তাদের জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না। এগুলো বিক্রি করে সে অর্থ দিয়ে আমি তাদের জন্য খরচ করব।
একথা শুনার পর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজন পিতাকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। তাদেরকে এভাবে খালি হাতে ফেরত দিয়ে স্নেহশীল পিতা যে পরম শান্তিতে থাকতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। সারাটি দিন কর্মক্লান্ত আদরের মেয়েটির চেহারা তাঁর মনের মধ্যে ভাসতে থাকে। সন্ধ্যা হলো। ঠা-াও ছিল প্রচ-। আলী-ফাতিমা শক্ত বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এত ঠা-ায় কি ঘুম আসে? এমন সময় দরজায় করাঘাতের শব্দ। দরজা খুলতেই তাঁরা দেখতে পান পিতা মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) দাঁড়িয়ে। তিনি দেখতে পান, এই প্রবল শীতে মেয়ে-জামাই যে কম্বলটি গায়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, তা এত ছোট যে দুজন কোন রকম গুটিসুটি মেরে থাকা যায়। মাথার দিকে টানলে পায়ের দিকে বেরিয়ে যায়।
আবার পায়ের দিকে সরিয়ে দিলে মাথার দিকে আলগা হয়ে যায়। তাঁরা এই মহান অতিথিকে স্বাগতম জানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে ব্যস্ত না হয়ে যে অবস্থায় আছে সেভাবে থাকতে বলেন। তিনি তাঁদের অবস্থা হৃদয় দিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, তারপর কোমল সুরে বলেন: তোমরা আমার কাছে যা চেয়েছিলে তারচেয়ে ভাল কিছু কি আমি তোমাদের বলে দেব? তাঁরা দুজনই এক সঙ্গে বলে উঠলেন: বলুন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন: জিবরীল আমাকে এই কথাগুলো শিখিয়েছেন: প্রত্যেক নামাজের পরে তোমরা দুজন দশবার সুবহানাল্লাহ, দশবার আলহামদুলিল্লাহ ও দশবার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। আর রাতে যখন বিছানায় ঘুমাতে যাবে তখন সুবহানাল্লাহ তেত্রিশবার, আলহামদুলিল্লাহ তেত্রিশবার, আল্লাহু আকবার চৌত্রিশবার পাঠ করবে। একথা বলে তিনি মেয়ে জামাইকে রেখে দ্রুত চলে যান। (বুখারী, মুসলিম) (চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব