ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

রেজাউল হাসান

প্রকাশিত: ১৯:০২, ১৭ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:২০, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

(পূর্ব প্রকাশের পর)
ওর জীবনের শুরুটা ছিল বেশ বর্ণময়-এই মীনা কুমারী তাতে এসে সব ভন্ডুল করে দিল। ওর খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছাড়তে হলো দেশ আর তাতেই ঘটলো ছন্দ পতন। সব কিছুই হয়ে গেল ওলট পালট। এই সুন্দর প্রানবন্ত পৃথিবীতে শুধু তারই ঠাঁই হলো না। নাভির থেকে একটা দীর্ঘশ^াস উঠে তা মাঝ পথে আটকে গেল। বিয়ার পানের পর সিগ্রেট বড়ই আরাম দায়ক। সিগ্রেট ধরালো-কিন্তু সেই সাধটা পেলনা। এসট্রেতে সিগ্রেটটা গুঁজে দিয়ে ও ভাবলো আরে মর্টিনই তো কেনা হয়নি।
ও মর্টিন কেন কিনছে-দোকানীর যেন এ রকম কোন সন্দেহ না হয় এ রকম বোকা সোকা একজন দোকানী পেয়ে গেল। হাতে না নিয়ে মর্টিন টা পিঠের দিকে গেঞ্জির ভাজে রেখে দিল।
হোটেলে ফিরে এসে আফতাব ভাবে সুইসাইডাল নোটটা লিখতে শুরু করবে কিনা! ভাবে নোটের কথা তো হবে খবুই সংক্ষিপ্ত। ঘটনাটা ঘটাবে ও মাঝ রাত্তিরের পর। এরমধ্যে হোটেলের হাউজ কিপিং-এর লোক যদি এসে পড়ে..মর্টিন আর নোট যদি দেখে ফেলে তহ’লে তো কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। আত্নহত্যার বিষয়টি ধরা পড়ে গেলে সেটা হবে পরিবারের জন্যে খুবই লজ্জাজনক। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আফতাব ঘুমিয়ে যায়।
ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পায় ন’টা বেজে গেছে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় নগরী আলোতে ভাসছে। অনেক দালান কোঠা। ধীরে ধীরে নগরী আধুনিক হয়ে ওঠেছে। একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে ভাবে এটা এখন তিলোত্তমা নগরী হলেও এখানে এখন আর তার হৃদয় বাঁধা থ্কবে না। হঠাৎ আফতাবের মনে হয়, সে কেন কাল রাতে এই আত্নহননের সিদ্ধান্ত নিল। ওর হৃদয়ে যেন একটু আলো জ¦লে ওঠে। বিষয়টি ও ছাড়া তো আর কেউ জানেনা। আবার কি চেষ্টা করে দেখতে পারেনা-ও কি তার ভাগ্য ফেরাতে পারে কিনা! শুরুতে কি কষ্টের জীবন ছিল ওর-সেই কষ্টটা যখন জয় করতে পেরেছিল-এখন কেন ওর মনোবল ভেঙ্গে গেল! তাছাড়া ওর বর্তমান স্ত্রী ওকে মনপ্রান দিয়ে ভালবাসে-ওর একার আয়ে সংসার চলছে না-তারপরেও বেচারী আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ও চলে গেলে সে খুব কষ্ট পাবে। এই শোক কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে কি সম্ভব হবে? হয়তো নয়। আমেরিকা থেকে ঢাকায় নেমেই এক বন্ধুর বাড়িতে এক পার্টি হচ্ছিল-সেখানেই আলাপ হয় ওর বর্তমান স্ত্রী অনামিকার সঙ্গে। ভাললাগা ভালবাসা তারপরে গিয়ে গড়ায় পরিণয়ে। অনামিকা ওকে সাহস জুগিয়েছে,প্রেরণা জুগিয়েছে তার বুকটা এভাবে ভেঙ্গে দেয়ার কি অধিকার আছে তার! সে তার সিদ্ধন্তে অটল থাকতে পারছেনা। একটু একটু করে সংশয় দেখা দিচ্ছে। গৌতম বুদ্ধু বলেছেন, আত্নহত্যা মহা পাপ। আফতাব আপন মনেই হেসে ওঠে। সে এখন পাপপূণ্যের অনেক উর্দ্ধে। সে একজন পুরুষ মানুষ-সে বরং এখন সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেই বরং কাপুরুষ হয়ে যাবে। গুণী লোকেরা অবশ্য বলে, আত্নহত্যা কাপুরুষিত কাজ। আফতাবের মাথায় ব্যথাটা আবার চারা দিয়ে ওঠতে শুরু করেছে। সে আবার বারে গিয়ে বসে। বিয়ারটা পান করার পর একটু ধাতস্থ হলো। নিজের মনেই হিন্দী সিনেমার সংলাপ আওড়ায়-সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি তখন চলেই যাব। কেউ আমাকে আটকিয়ে রাখতে পারবেনা।
এলিভেটরে ওঠার আগ মুহূর্তে একটা নারী কন্ঠ শুনতে পেল। ওর নাম ধরে ডাকছে। ও ভয় পেয়ে পা চালায়-কেউ নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছে। এই শালার টক শোতে গিয়েই সব ঝামেলা হয়েছে। এখন শান্তিমতো মরতেও পারবোনা। মহিলাটা এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। এক ঝটকায় চিনতে পারে-নীলুফার জাহান। নীলুফার অবাক হয়ে বলে, আমি কিন্তু আপনাকে সেই দুপুরে দেখেই চিনতে পেরেছি। বিকেলে দেখলাম বেরিয়ে গেলেন। আমি তো লবিতেই আছি আপনার গতি বিধি লক্ষ্য করছি। আপনি বেশ ক’বার আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। আপনাকে একবার লন্ডনে আসতেও বলেছিলাম। পরে দেশে এসে শুনলাম,আপনি আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। নীলুফারের কথা শুনতে আফতাবের ভাল লাগছেনা। মাতালের ভান করে আফতাব বলে, খুব ভাল লাগলো, আপনার সঙ্গে দেখা হলো। নীলুফার অবাক হয়। বলে, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে আমার বেশ নাম ডাক হয়েছে। আপনি আমার পুরণো বন্ধু-আপনার সঙ্গে এসব নিয়ে শেয়ার করবো না? কি বলেন, আপনি ছিলেন একজন প্রমিজিং ইয়ং জার্নালিস্ট অথচ আপনাকে এখন কেউ চেনেনা। আমি তো এখানে ফিরে এসেছি তা বছর দুয়েক হলো-আপনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে,কি করছেন,কেমন আছেন বা আপনার কোন সাহায্যে আমি আসতে পারি কিনা-এসব আমার মনে আছে। কিন্তু কোথায় পাবো-আপনাকে? আই এ্যাম সিঙ্গল-স্টিল ইজ লাভ উইথ ইউ..আফতাব ভেতরে ভেতরে ভাঙতে শুরু করলেও পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে। বলে, দেখুন, আমি একটা কাজে ভীষণ ব্যস্ত..আপনি তো ঢাকায়ই আছেন। নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। নীলুফার কৌতুহলী ভঙ্গিতে বলে, কি কাজে ব্যস্ত আছেন আপনি-না তুমি করেই বলছি। আমরা তো পরস্পরকে তুমি বলেই সম্বোধন করতাম। আফতাব কিছুটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে, বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত। আর তাছাড়া আপনার আর কোন কিছুই আমার মনের ভেতর নেই। আর আমি সিঙ্গলও নই। আমার স্ত্রী আছে। তাকে ছেড়ে তো আপনার গলায় ঝুলে পড়তে পারিনা। আফতাবের ইঙ্গিতটা খুবই কদর্য। তারপরেও নীলুফার রাগেনা বলে, তুমি রুমে যাচ্ছো? আমিও যাবো। আফতাব এবারে রেগে যায়। বলে, আপনি কিন্তু সত্যিই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। নীলুফার নিস্পৃহ কন্ঠে বলে, একটুও না। আমি মানুষের মনের কারবারী। ইউর বিহেভিয়ার ইজ নট নরমাল। আমি রিসিপশনে খবর নিয়েছি। তুমি সেখানে বলেছো তুমি এসেছো ইভেন্ট কভার করতে-কিন্তু ওখানে তোমাকে দেখা যায়নি। নীলুফার আফতাবের হাত ধরে। বলে, তুমি কি ডিনার করেছো? আফতাব বলে, আমার ক্ষিধে নেই। নীলুফার অবাক হয়। কেন ক্ষিধে থাকবেনা কেন? নীলুফার আফতাবের হাত ধরে টানতে টানতে লবির এক কোণে গিয়ে বসে। সাপ যেমন মানুষের দু’পা পেচিয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। নীলুফারও তেমনি আফতাবকে পেচিয়ে ধরেছে। ছাড়ছেনা। আফতাব শেষ চেষ্টা করে বলে, আপনিই তো অর্গানাইজার-আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেন? আপনার তো ওখানেই থাকা উচিত। ওখানের চেয়ে এখন তোমাকেই আমার সময় দেয়াটা বেশী জরুরী। আফতাব অবাক হয়। বলে, এসব আপনি কি বলছেন? আমাকে কেন আপনি সময় দেবেন? কেন? নীলুফার অবাক বলে, তোমাকে কেন সময় দেব বা দেওয়াটা কেন আমার জন্যে জরুরী তা তুমি নিজেকেই জিগ্যেস করনা কেন! আফতাব বিরক্ত হয়। বলে, আপনার কথা কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। এবারে নীলুফার সরাসরি আফতাবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, হোটেলে তুমি কি করতে এসেছো? আস্ক ইউর সেলফ। ইউ আর লাকি-ইউর ওয়াইফ অলসো লাকি তুমি উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তোমাকে ধরে ফেলেছি। আফতাব নিজে কে আর সামলাতে পারেনা। ওর গা গুলিয়ে আসছে। নাড়ি ভুড়ি ছিড়ে কি যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। আফতাব ঘাড়টা এলিয়ে দেয়। নীলুফার সিকুরিটির লোকজনের সাহায্যে আফতাবকে তার রুমে নিয়ে যায়। রুমে বসিয়ে আফতাবকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। আফতাব ঘুমিয়ে যায়। মর্টিনের কৌটাটা নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের দিয়ে দেয়। নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের সাবধান করে দিয়ে বলে,বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাদের জন্যে ভাল হবেনা। তারা বলে, ঘটনাটা ঘটলে তো নিশ্চয়ই তাদের হোটেলের সুনাম ক্ষুন্ন হতো। যদিও তারা এর সাথে কোন ভাবেই জড়িত নয়।
পরের দিন সকালে আফতাবের স্ত্রীকেও নীলুফার ডেকে নিয়ে আসে হোটেলে। বলে, আমরা ডেঞ্জারাস টাইমটা ওভার কাম করেছি। ও এখন ইচ্ছে করলেও ওটা করতে পারবেনা। ইট’স ব্লকড। আর আমি তো আছিই। নীলুফার আফতাবের স্ত্রীকে বলে,  বেশীরভাগ মানুষই মানবেতর জীবন যাপন করেও বেঁচে থাকার আকাংখা জাগিয়ে রাখে আবার কিছু লোক সামাণ্যতেই ভেঙ্গে পড়ে। এবং বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মানুষ যখন একা হয়ে যায়,তখন তার মাথায় আত্নহত্যার ভ ূত চেপে বসে। আফতাবের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নীলুফার বলে,  তোমার অবশ্য এসব বোঝা ও জানার কথা নয়। যা হোক ওকে এখন থেকে চোখে চোখে রাখবে। প্রেরণা জোগাবে। মেয়েরা অবশ্য এ কাজটি ভাল জানে।
গুড লাক ফর ইউ। এনি ওয়ে হি ইজ নট লিভিং আস। বলে আফতাবের বউয়ের কাঁধে চাপড় মারে। এবং আফতাব যদি সত্যি সত্যি ঘটনা-টা ঘটাতো তাহ’লে মিডিয়া বিশেষ কওে ইরেকট্রনিক মিডিয়া যেভাবে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো তার থেকে রক্ষা নীলুফার জাহান ওকে যেভাবে রক্ষা করলো সেই কৃতজ্ঞতায় নীলুফাকে সে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। নীলুফার ওকে কাঁদতে দেয়। কিছু বলেনা। (শেষ)

প্যানেল

×