ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ফ্ল্যাশ ফিকশন -স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ধারা

​​​​​​​আবু সাইদ কামাল

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ৬ জুন ২০২৪

ফ্ল্যাশ ফিকশন -স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ধারা

.

একটি অসাধারণ গল্প বলার জন্য উপন্যাস লেখার দরকার নেই। জন্য ফ্লাশ ফিকশনের জগতে অনধিক ২০০০ শব্দের প্রয়োজন। ফ্ল্যাশ ফিকশন হলো অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্বল্পতম শব্দ গণনায় একটি সম্পূর্ণ গল্প। এটি শুধু ছোট গল্প নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। সৃজনশীলতায় এটি আবেগের এমন বিস্ফোরণ ঘটায় যা পাঠককে শ্বাসরুদ্ধকর করে তুলে।

পটভূমি: ফ্লাশ ফিকশন বা ঝলক কল্পকাহিনীর একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। এর শিকড় প্রাগৈতিহাসিককালে প্রোথিত। যার মধ্যে রয়েছে উপকথা, দৃষ্টান্ত, উল্লেখযোগ্যভাবে পশ্চিমের ঈশপের উপকথা, ভারতের পঞ্চতন্ত্র এবং জাতক কাহিনী। পরবর্তী উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে নাসিরদ্দিনের গল্প এবং জেন কোয়ানস এর গেটলেস গেট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ফ্ল্যাশ ফিকশনের প্রাথমিক রূপগুলো ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে পাওয়া যায়। বিশেষত ১৯ শতকে ওয়াল্ট হুইটম্যান, অ্যামব্রোস বিয়ার্স এবং কেট চোপিনের পরিসংখ্যান উল্লেখযোগ্য।

১৯২০ এর দশকে ফ্ল্যাশ ফিকশনকেসংক্ষিপ্তফিকশন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা ছিলেন সমারসেট মম। তাঁর কসমোপলিটানস: ভেরি শর্ট স্টোরিজ (১৯৩৬) একটি প্রাথমিক সংকলন ছিল। জাপানে, যুদ্ধোত্তর যুগে ফ্ল্যাশ ফিকশনে মিচিও সুজুকি এই ধারায় জনপ্রিয় হয়েছেন।

১৯৮৬ সালে ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির জেরোম স্টার্ন অনুর্ধ ২৫০ শব্দের গল্প নিয়ে বিশ্বের সেরা ছোটগল্প প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। প্রথম বিজয়ী মাইকেল মার্টোন পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন ১০০ ডলার ফ্লোরিডা কমলার ক্রেস্ট।

১৯৯২ সাল পর্যন্ত ফ্ল্যাশ ফিকশনশব্দটি কথাসাহিত্যের একটি বিভাগ বা ধারা হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি রচনা করেন জেমস থমাস, যিনি ডেনিস থমাস এবং টম হাজুকার সঙ্গে একসঙ্গে ১৯৯২ এর ল্যান্ডমার্ক নৃবিজ্ঞান শিরোনামে সম্পাদনা করেছিলেন ফ্ল্যাশ ফিকশন : ৭২ অতি ছোট গল্প। এবং টমাস সেই ন্ডে ভূমিকায় এটি প্রবর্তন করেছিলেন। তখন থেকে এই ধারাটি একটি ফর্ম হিসাবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে।

ফ্ল্যাশ ফিকশন কী : ফ্ল্যাশ ফিকশন হল ছোট গল্প লেখার একটি রূপ যা সীমিত সংখ্যক শব্দের মধ্যে একটি পাঞ্চ প্যাক করে। এটি এমন একটি ধারা যা লেখকদের সংক্ষিপ্ত হতে চ্যালেঞ্জ করে, যা তাদের পাঠকদের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা বা আবেগ প্রকাশ করে। উপরন্তু, ফ্ল্যাশ গল্প নতুন ধারণা তৈরি করতে বা লেখকের বৃত্তাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে। কারণ এই ধারার সংক্ষিপ্ততার চর্চার কিছু অন্বেষণের প্রেরণা দেয়।

ফ্ল্যাশ ফিকশনের একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল ছয় শব্দের গল্প: ‘বিক্রয়ের জন্য; শিশুর জুতা, কখনও পরা নয়।মাত্র ছয়টি শব্দে আমরা একটি প্লট দেখতে পাই: কিছু বিক্রয়ের জন্য।বেবি জুতোচরিত্রটি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানায়। অতঃপর গল্পের রেজোলিউশন বা স্পষ্টতা বিকশিত হয়: বাচ্চাদের জুতো কখনও পরা হয়নি। এটি পাঠককে অনুমান করতে দেয় যে, একটি শিশুর সঙ্গে দুঃখজনক কিছু ঘটেছে। তবে শব্দ সংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও ট্র্যাজেডিতে মর্মস্পর্শীতার অভাব নেই বা দুঃখজনক ঘটনার একটা বার্তা পেতে অসুবিধা হয় না।

এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটি একটি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর দিকে ইঙ্গিত করে এবং শুধুমাত্র কয়েকটি শব্দে একটি সম্পূর্ণ গল্প বলার এবং আবেগ জাগিয়ে তোলার মতো একটি ঘরানার ক্ষমতা প্রদর্শন করে।

ফ্লাশ ফিকশন, সাডেন ফিকশন বা আকস্মিক কথাসাহিত্য নামেও পরিচিত। এটি গল্প লেখার এমন একটি শৈলী যা সংক্ষিপ্ততা, তীব্রতা এবং একটি মোচড়ের সমাপ্তির ওপর জোর দেয়। ফ্ল্যাশ ফিকশন জগতে প্রতিটি শব্দ গণনা করে। সীমিত পরিসরে অতি সংক্ষিপ্ত হলেও প্রভাবশালী গল্প তৈরি করতে পারে।

এই ঘরানায় চ্যালেঞ্জ হলো, একটি সম্পূর্ণ আখ্যান তৈরি করা, যা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং মাত্র কয়েকশ শব্দে পাঠকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে। এখানেই ফ্ল্যাশ ফিকশনের শিল্পটি খেলায় আসে। নৈপুণ্যে দক্ষতা অর্জন করে। ধারায় লেখকরা এমন গল্প তৈরি করতে পারে যাতে উদ্ভাবনী শক্তিমত্তা  দেখাতে সক্ষম হয় এবং সৃষ্টিকর্মকে স্মরণীয় করতে পারে। সুতরাং, ফ্লাশ ফিকশন বা ঝলক কল্পকাহিনীর জগতে ডুব দিলে কিভাবে এই ধারাটি গল্প লেখায় এত অনন্য করে তোলে, তা আবিষ্কার করা যায়।

এটি যা ধারণ করে

. ফ্ল্যাশ ফিকশন হল সংক্ষিপ্ত গল্পের এমন একটি ধারা যা সংক্ষিপ্ততা, তীব্রতা এবং মাত্র কয়েকশ শব্দের মধ্যে একটি মোচড়ের উপর জোর দেয়।

. ফ্ল্যাশ ফিকশন চর্চা লেখকদের দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করে। নতুন ধারণা তৈরি করতে এবং লেখকের বৃত্তবন্দি অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। কথাসাহিত্য চর্চায় এটিকে একটি থেরাপিউটিক টুল হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

. ফ্ল্যাশ ফিকশন ঐতিহ্যগত গল্প বলার রীতিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সৃজনশীল অভিব্যক্তির জন্য একটি প্রাঞ্জল এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রস্তাব দেয়। পাঠক এবং লেখক উভয় ক্ষেত্রেই অনুপ্রেরণাদায়ক চ্যালেঞ্জ এটি।

ফ্ল্যাশ ফিকশনের শিল্পরূপ

ফ্ল্যাশ ফিকশনের সৌন্দর্য তার সংক্ষিপ্ততায়। যা লেখকদের বাধ্যতামূলকভাবে মাত্র কয়েকশ শব্দের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ আখ্যান তৈরি করতে দেয়।

ফ্ল্যাশ ফিকশন ধারায় লেখার কৌশল বড় ভূমিকা পালন করে। পাঠকের সঙ্গে সংবেদনশীল সংযোগ তৈরি করার সময় লেখককে কেবল অপর্যাপ্ত শব্দ দিয়ে একটি সম্পূর্ণ গল্প বলতে সক্ষম হতে হবে। একটি অনন্য এবং চিত্তাকর্ষক গল্প নিয়ে আসার জন্য সৃজনশীল অনুপ্রেরণাও প্রয়োজন, যা পাঠককে ব্যস্ত রাখবে।

ফ্ল্যাশ ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে প্রাণবন্ত ভাষা এবং সংবেদনশীল বিবরণ ব্যবহার করা ফ্ল্যাশ গল্পের তীব্রতাও এর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। প্রাণবন্ত ভাষা এবং সংবেদনশীল বিবরণের ব্যবহার পাঠকের ওপর একটি শক্তিশালী সংবেদনশীল প্রভাব তৈরি করতে পারে। উপরন্তু, একটি মোচড় দেওয়া সমাপ্তি ফ্ল্যাশ ফিকশনের একটি বৈশিষ্ট্য। শেষের দিকে অপ্রত্যাশিত টুইস্ট বা মোচড় পাঠকের উওপর স্থায়ী ছাপ ফেলতে পারে, গল্পটিকে স্মরণীয় এবং প্রভাবশালী করে তুলতে পারে।

গতিশীল ভুবনে যখন কথাসাহিত্য লেখার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই, তখন ফ্ল্যাশ ফিকশনে চর্চারপচেষ্টায়, ধারার সৃজনশীলতায় অনেক দূর নিয়ে যাবে।

ফ্ল্যাশ ফিকশনলিখার কৌশল

সীমিত শব্দ সংখ্যায় একটি দুর্দান্ত গল্প বলার জন্য ফ্ল্যাশ ফিকশন গল্পগুলির কয়েকটি মূল উপাদান প্রয়োজন।

প্রথমত, গদ্যভাষাটাইট বা কমপেক্টহওয়া উচিত। এর অর্থ প্যাসিভ ভয়েসের পরিবর্তে সক্রিয় ভয়েস ব্যবহার করা। অপ্রয়োজনীয় শব্দ, বিশেষ করে ক্রিয়াবিশেষণ ত্যাগ করা। পাঠকের মনে একটি ইমেজ তৈরি করতে পাওয়ার ক্রিয়া ব্যবহার করার দিকে মনোনিবেশ করা।

দুর্দান্ত ফ্ল্যাশ কল্পকাহিনীকেও ঠিক কার্যকরভাবে শুরু করতে হবে এবং যতটা সম্ভব অপ্রয়োজনীয় পটভূমির তথ্য মুছে ফেলতে হবে। প্রদত্ত কাঠামোর মধ্যে অর্থ পূরণ করতে পারে পাঠককের মনে এমনআস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে হবে।

ফ্ল্যাশ গল্পে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যিক ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যেমন: চিত্রকল্প, প্রতীকবাদ, জুক্সটাপজিশন এবং রূপক। এই ডিভাইসগুলি পাঠককে গল্পে টানতে এবং মর্মস্পর্শীতা তৈরি করতে সহায়তা করে।জুক্সটাপজিশন হলো: তুলনা বা বৈসাদৃশ্য বা একটি আকর্ষণীয় প্রভাব তৈরি করার জন্য প্রায়শই দুই বা ততোধিক জিনিসকে পাশাপাশি রাখার একটি উদাহরণ।

ফ্ল্যাশ কল্পকাহিনীতে প্রায়শই একটি প্লট টুইস্ট বা অবাক করা সমাপ্তি দেখা যায়, যেমনটি আমরাবেবি শুউদাহরণে দেখেছি। অথবা গল্পের শেষ বাক্যটি প্রথম বাক্যটির বিপরীত হতে পারে। এটি লেখককে সংক্ষিপ্ত শব্দ গণনার মধ্যে প্লটের গতিবিধি অর্জন করতে সহায়তা করে।

ফ্ল্যাশ ফিকশন কেনো লেখা উচিত

ফ্ল্যাশ ফিকশন সংক্ষিপ্ত হতে পারে, তবে এটি অন্য যেকোনো ধরনের লেখার চেয়ে সহজ নয়। প্রকৃতপক্ষে, অনেক দীর্ঘ-ফর্মের লেখকদেও এই ধারায় গল্পলেখা আরও চ্যালেঞ্জিং মনে হবে।

ফ্ল্যাশ ফিকশন চর্চায়লেখকের লেখার দক্ষতা তীক্ষ করার একটি দুর্দান্ত উপায়। নিজেকে ,৫০০ শব্দের নিচে থাকতে বাধ্য করে গদ্যভাষাস্পষ্ট করতে সাহায্য করে।রতিকা দেশপান্ড এর মতে সীমাবদ্ধতা মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে।

এটি গল্প লেখার দক্ষতা উন্নত করে। কারণ ধারায় অবশ্যই গল্প লেখার চর্চা চলমান রাখতে হয়। লেখককে পিছনের গল্প ছাঁটাই করতে বাধ্য করে। তাই গল্পের অর্থ অর্জনের জন্য চিত্র, প্রতীক, শব্দ চয়ন এবং আরও অনেক কিছু ব্যবহার করার অনুশীলন করতে হয়।

ফ্ল্যাশ ফিকশন প্লট টুইস্ট লেখার অনুশীলন করার একটি মজার উপায়ও। গল্পলেখক সংবেদনশীল বিবরণ উন্নত করতে পারে এবং সাহিত্যিক ডিভাইসগুলির সাথে এমনভাবে খেলতে পারে, যা আগে কখনও ব্যবহার করা হয়নি।

এক্ষেত্রে ফ্ল্যাশ গল্প সম্পাদনা করতে এবং দক্ষতা বাড়াতে ProWritingAid ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রোরাইটিং এইড হলো এমন একটি প্যাকেজ, যে প্যাকেজে থাকে সেরা ব্যাকরণ পরীক্ষক, স্টাইল সম্পাদক এবং লেখার পরামর্শদাতা। এই প্যাকেজে প্যাসিভ ভয়েস, অপ্রয়োজনীয় শব্দ, অত্যধিক ক্রিয়াবিশেষণ ব্যবহাওে অনুৎসাহিত করাসহ আরও অনেক বিষয় নির্দেশ করতে পারে।

দুই

ফ্ল্যাস ফিকশন সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা। গত সাত আট বছর ধরে বৃটেনেø্যাস ফিকশন ডে পালিত হয়ে আসছে। নিউজিল্যান্ডেও জাতীয় অনুগল্প দিবস পালিত হয়। ফ্ল্যাস ফিকশন লেখেম্যান অব বুকারপুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেবিস। ডেবিসের  গল্পের দৈর্ঘ্য এক লাইন থেকে শুরু করে তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত। ছোটগল্পের পাশাপাশি ফ্ল্যাস ফিকশন লেখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আর এক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার। বার্টলার  ডেভিসের অনেক আগে ছোটগল্পের পাশাপাশি ফ্ল্যাস ফিকশন লেখে বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের প্রথম নোবেলজয়ী ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা। বিখ্যাত ফ্ল্যাশ ফিকশন লেখকদের মধ্যে রয়েছে নীল গাইমান, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং মার্গারেট অ্যাটউডকাফকা, আর্থার সি ক্লাক, রে ব্রাডবুর, নগিব মাহফুজ, ডোনাল্ড বার্থলেম, অ্যাব্রুস বিয়ার্স, কেট সপা, শেখব প্রমুখ। এই জগতে অনেক ছোট গল্পের সংগ্রহ রয়েছে এবং রয়েছে অনলাইন প্রকাশনাও।

ø্যাস ফিকশনবা ঝলকগল্প এখন সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ধারা বা ঘরানা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। ফ্ল্যাস ফিকশনে বেঁধে দেওয়া কোনো শব্দসীমা নাই। কেউ কেউ মনে করেন ১০০শব্দের মাঝে ফ্ল্যাস ফিকশন হওয়া উচিত। আবার কেউ কেউ ১০০০ শব্দের নিচের যে কোনো ছোটগল্পকে ফ্ল্যাস ফিকশন বলে মনে করেন। মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে(১৮৯৯-১৯৬১) মাত্র ৯০০ শব্দেক্যাট ইন দ্য রেইনফ্ল্যাস ফিকশনটি লেখেন। আবার তিনি মাত্র শব্দে একটি একটি অনুগল্প লেখেন:`For sale: baby shoes, never worn হন্ডুরাসের লেখক Augusto Monterroso (১৯২১-২০০৩) সাত শব্দের এপিক বলে খ্যাতডাইনোসরগল্পটি লেখেন: `When he awoke, the dinosaur was still there.

চীনা সাহিত্যে ফ্ল্যাস ফিকশনের শব্দসীমাস্মোক লংহিসাবে শব্দসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একটা সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে, তার মাঝেই ক্ষুদে গল্প শেষ করতে হবে।

আধুনিক বাংলাসাহিত্যে ফ্ল্যাস ফিকশনের ধারায় রবীন্দ্র-নজরুল-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-বনফুলসহ প্রতিষ্ঠিত অনেক গল্পকারই এই ধরার গল্প লিখেছেন। সম্প্রতি বাংলায় ভাষায় অনেকেই ফ্ল্যাস ফিকশন লিখছেন। পত্র পত্রিকায় স্থানাভাবে যে সব অতি ছোট আকারের গল্প প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোর অনেক গল্পই ফ্ল্যাস ফিকশনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হচ্ছে।

ফ্ল্যাস ফিকশন বা অতি ছোট গল্পে অল্পকথায় অনুভবের বিষয়টি তুলে আনা হয়। বোদলেয়ারের মতো অনেক কবি ক্ষুদে গদ্য কবিতা লেখেছেন, যেগুলো অনুগল্প হিসাবে বিবেচনা করা যায়। হালের জনপ্রিয় মার্কিন কবি গল্পকার স্টুয়ার্ট ডাইবেকের অনেক ফ্ল্যাস ফিকশন বা অনুগল্প গদ্য-কবিতা হিসাবে সাহিত্যের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয়, কবিতা ছোটগল্পে- এই দুইয়ের বৈশিষ্ট্যই ক্ষুদে গল্পে থাকে।

কবিতার মতো ক্ষুদে গল্প নানামাত্রিক অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। একটি কাব্যিক দ্যোতনা বা ভাবমুদ্রা এতে থাকে। ভাষা হয় ঘন, রূপকাশ্রিত। একারণে মার্কিন কবি গ্রেস পালে বলেন, অতি ছোট গল্প কবিতার মতোই ধীরে পড়া উচিৎ। অন্যদিকে গল্পের মতোই সমাজবাস্তবতার কোনো সুপ্ত চেতনাকে অনুগল্পে ইঙ্গিত করা হয়। এতে চরিত্র থাকে, থাকে ডায়লগ। একটা চমৎকার সমাপ্তিও থাকে। গল্প আরম্ভ করে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চমক দিয়েই শেষ হয়।

ফ্ল্যাস ফিকশনের সঙ্গে ছোটগল্পে পার্থক্য হলো, ছোটগল্প নির্মিত হয় কতগুলো মুহূর্ত নিয়ে; যেখানে কতগুলো দৃশ্যকে আশ্রয় করে কতগুলো ঘটনার প্রকাশ ঘটে। আর অতি ছোট গল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একটি দৃশ্যপটে উপস্থাপিত হয়। পরিষ্কার করে কিছু বলা হবে না, কেবল একটা ইঙ্গিত দিয়েই শেষ করা হবে।

ছোটগল্পের শেষে চমক থাকতেও পারে, নাও পারে। তবে ক্ষুদে গল্পে মৃদুভাবে চমক থাকলে ভালো হয়। যেমন : বনফুলের নিমগাছ গল্পে নিম গাছের উপকারিতা সম্পর্কে বলে সেটির ওপর মানুষের নিষ্ঠুর আচরণ বিষয়ে বলতে বলতে হঠাৎ কথক বলেন, পাশের বাড়ির বৌটির একই দশা। এখানেই গল্প শেষ।

চমক সৃষ্টি করেছেন আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-১৯৮৪) তাঁরContiuty of the parks গল্পে দেখা যায় এক ব্যবসায়ী বুঁদ হয়ে উপন্যাস পড়ছেন। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে নায়ক নায়িকা উদ্যানের ঝোপের আড়ালে দেখা করেছেন। আসার সময় গাছের ডালের আঁচড়ে নায়কের মুখের ত্বক কেটে গেছে। নায়ক বলে, এভাবে আর লুকিয়ে দেখা করতে পারবো না। কিছু একটা করা দরকার।

ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, নায়িকার স্বামীকে দুজনে মিলে খুন করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা নায়িকার বাড়ি গেলো। চাকু হাতে প্রেমিক। প্রেমিকার স্বামী তখন চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে উপন্যাস পড়ছেন। এখানেই গল্প শেষ। অর্থাৎ গল্পের শুরুতে যে পাঠক মনোযোগী হয়ে উপন্যাস পড়ছিল, উপন্যাসটির শেষ না করতেই প্রেমিকার পরকীয়া প্রেমের বলি হচ্ছে।

বহির্বিশ্বে ছোটগল্পের যে ধারাটি ফ্লাস ফিকশন নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশে তা অনুগল্প হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। ফ্ল্যাস ফিকশনের বাংলা পরিভাষাঅনুগল্পহওয়াতে সংগত কারণে ভিন্নমত পোষণ করছি। ফ্ল্যাস ফিকশনের প্রকারভেদ বিশ্লেষণ করলে তা স্পষ্ট হবে বলে মনে করি।

ফ্ল্যাশ ফিকশনের প্রকারভেদ

ফ্ল্যাস ফিকশান সাধারণত ছয় প্রকারের :

. আকস্মিক কথাসাহিত্য/ছোট গল্প (Sudden fiction/Short short stories) : আকস্মিক কল্পকাহিনী এবং ছোট ছোট গল্পগুলো প্রায় ৭৫০ থেকে ,০০০ শব্দের ফ্ল্যাশ ফিকশনের দীর্ঘ অংশকে  বোঝায়। এবং ,০০০ পর্যন্ত শব্দের গল্পও ধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

. পোস্টকার্ড কথাসাহিত্য (Postcard fiction):  পোস্টকার্ড কথাসাহিত্য বলতে যা শোনায় তা- এমন একটি গল্প যা পোস্টকার্ডের মতো স্বল্প পরিসরে লেখা যেতে পারে। এটি সাধারণত প্রায় ২৫০ শব্দ কিংবা ৫০০ বা ২৫ শব্দেরও মতো হতে পারে।

. মাইক্রোফিকশন/ ন্যানোফিকশন (Microfiction/ Nanofiction) : মাইক্রোফিকশন এবং ন্যানোফিকশন ফ্ল্যাশ ফিকশনের সংক্ষিপ্ত রূপ বর্ণনা করে, ৩০০ শব্দ বা তার কম শব্দসীমায় ধারার গল্প রচিত হয়। মাইক্রোফিকশনের মধ্যে ড্র্যাবল, ড্রিবল এবং ছয় শব্দের গল্পের মতো ফর্ম রয়েছে। ধারার ক্ষুদে গল্পকে অনুগল্প অভিধায় অভিহিত করা যায়।

. ড্রেবল (Drabble): ড্র্যাবল ঠিক ১০০ শব্দের একটি গল্প (শিরোনামসহ নয়) ফর্মটি সংক্ষিপ্ত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, একটি ভালো গল্পের মূল বিষয় এড়ানো যায়। এটির একটি শুরু, মধ্য এবং শেষ থাকা উচিত এবং এতে দ্বন্দ্ব এবং সমাধান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

. ড্রিবল/মিনি-সাগা (Dribble/Mini-saga): যখন একটি ড্রেবল লেখা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং না হয়, একটি ড্রিবল লেখার জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে, যা ঠিক ৫০ শব্দে বলা একটি গল্প।

. ছয় শব্দের গল্প (Six-word stories) : ছয় শব্দের গল্পও লেখার চেষ্টা করা যায়। এটি সহজ নয়, তবে ফ্ল্যাশ ফিকশন আগ্রহীদের মতে, ছয়টি শব্দে দ্বন্দ্ব এবং রেজোলিউশনসহ একটি সম্পূর্ণ গল্প লেখা সম্ভব। ছয়-শব্দের গল্পের সবচেয়ে সুপরিচিত উদাহরণ, প্রায়শই আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে উল্লেখ করা হয়, ‘বিক্রয়ের জন্য : শিশুর জুতা, পরা হয় না।

Krystal N. Craiker ফ্লাশ ফিকশনকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যেমন:

১। ছয় শব্দের গল্প

২। ড্রেবল : ১০০ শব্দ বা তার চেয়ে কম শব্দ

৩। টুইটার ২৮০ অক্ষর বা তার কম

৪। হঠাৎ কল্পকাহিনী ৭৫০ শব্দ বা তার চেয়ে কম

৫। ফ্ল্যাশ ফিকশন ১৫০০ শব্দ বা তার কম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষের মতে ফ্ল্্যাশ ফিকশন একটি সংক্ষিপ্ত কাল্পনিক আখ্যান যাতে চরিত্র এবং প্লট বিকাশিত হয়। শব্দ গণনা দ্বারা এসব ঝলক গল্পের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। যেমন: ১। ছয়-শব্দের গল্প; ২৮০-শব্দের গল্প। এটিটুইটারনামেও পরিচিত; ২।ড্রিবল’ :‘মিনিসাগানামেও পরিচিত, ৫০ শব্দ সীমায় এমন গল্প লেখা হয়; ৩।ড্র্যাবলৎ : ১০০ শব্দের গল্পমাইক্রোফিকশননামেও পরিচিত,; ৪।আকস্মিক কল্পকাহিনী’: ৭৫০ শব্দ;৫।ফ্ল্যাশ ফিকশন’:  ,০০০ শব্দের গল্প। উপরের প্রকারভেদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ছয় শব্দ থেকে শুরু করে ২০০০ পর্যন্ত শব্দের পরিসরে ফ্ল্যাস ফিকশন রচিত হয়। ফ্ল্যাশ ফিকশন গুরুত্বপূর্ণ জন্যই যে, এটি পাঠক এবং লেখক উভয়কেই একটি সৃজনশীল চ্যালেঞ্জ সরবরাহ করে, তাদের সীমিত শব্দে একটি সন্তোষজনক এবং চমৎকার গল্প লেখতে বাধ্য করে। ফ্ল্যাশ ফিকশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। লেখক যেমন এই ঘরানায় গুরুত্ব দিচ্ছে পাঠকও এর প্রতি ক্রমবর্ধমান হারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিশেষ করে নবীন বা এমাজিং লেখকদের মধ্যে এই ধরার গল্প চর্চার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

তথ্যসূত্র : ১। পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প, ছোটগল্পের শিল্প রূপান্তর- মোজাফফর হোসেন।

২। উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ

৩। রতিকা দেশপান্ডে রচিতফ্ল্যাশ ফিকশনের জন্য প্লট আইডিয়া কিভাবে তৈরি করবেনশিরোনামের একটি নিবন্ধ 

৪। অন্তর্জাল।

×