অন্তরালে
নৈঋতা গল্প লিখছে। বন্ধুমহলে খবরটি হট টক। কারণ লেখার বয়সটা একটা বাগড়া। এত বয়সে এসে কেউ লেখা শুরু করে ব্যাপারটা কৌতূহলের। নৈঋতাও সন্দিহান। আদৌ কি গল্প হচ্ছে! তাই গল্পটা লিখেই হোয়াইটস আপ করে বন্ধুদের। সঙ্গে তিন শব্দের চিরকুট- পড়ে মন্তব্য জানাইস। উত্তর না পেলে ঠিক পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে ফোন- কি রে লাবণী বললি না কেমন হইল? লাবণী হয়ত তখন মোবাইল থেকে বহু দূরে। হয়ত অফিসের কাজে, নয়ত ঘরের কাজে, কিংবা ওয়াশরুমে।
মেসেজ সে দেখেই নাই। তবুও গাল ফোলা রাগ দেখিয়ে বলে —-তোদের আর সময় হয় না। শেলী, কামরুল, দীপা, মিতা আর চন্দনাকেও পাঠাইছি কই কোনো তো সাড়া নাই। আচ্ছা বলতো, তোরা সবাই কি যুক্তি করে ওয়াশরুমে যাস?
শেলী ফোন দিয়ে ঝাড়ি নেয় লাবণীকে- আচ্ছা লাবণী, নৈঋতা পাইছেটা কি বলতো? বুইড়া বয়সে নাটক আর কত করব। হাবি-জাবি দুঃখের সাগর কি লেখে, লেইখ্যা আবার হোয়াইটস আপ করে, দশটা মিনিট সময় দেয় না। আরে বাবা, আজরাইল আইলেও তো একটু সময় দেয়! মানুষের কাজ নাই, সব ফালাইয়া তার গপ্পো পড়তে যাইব? ছেড়ির মাথা খারাপ হইছে।
লাবণী নৈঋতাকে খুব মায়া করে। শেলীকে নরম সুরে বলে— না না শেলী এইভাবে কইস না। কি করবে বল চাকরিটা ছাইড়া দিল। একটা কিছু নিয়া থাকুক না। তাছাড়া ভালোই তো লেখে। পড়ে দেখ তার লেখায় আঞ্চলিক টান আছে রে। গল্পগুলোও সেই আমাদের সময়ের। তাও তো দেশের কথা সে ভাবে। আর আমরা গাবের গাইল।
লাবণীর কথা শুনে চটে যায় শেলী ... তুই তো দেখি তার চেলা হইছিস রে। ভালোই তো ধামাধরিস।
মাথাডা ঠান্ডা কইরা ভাব... কি করবে ও। একটা কিছু নিয়া থাকুক।
শেলীর রাগ পড়ে নাই। গজগজ করছে... চাকরি তারে ছাড়তে কইছিল কে? আর এইটা তুই কি বলিস। কিছু একটা করুক, তাই বলে সাহিত্য রচনা। কি জ্ঞান আছে ওর। জীবনে কয়টা বই পড়ছে?
—-তুই কিন্তু এইটা বাড়াবাড়ি করতেছিস শেলী। বই না পড়ুক অভিজ্ঞতা তো আছে? জীবনের অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় কোনো বই নাই।
-পারলাম না লাবণী। সরি। এই কারণেই শুধু এই কারণেই বর্তমানে সাহিত্যের বারোটা বাজছে। আর আমাদের অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সবুজ মিয়াও কবিতার বই বের করে। আর সেই বই সংস্করণও হয়। মাবুদ তুমি রক্ষে করো।
—-তুই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সঙ্গে আমাদের নৈঋতার তুলনা দিলি? এম এ পাস একটা মেয়ে!
Ñসাহিত্য নিয়া তামাশা না। আগে জ্ঞান অর্জন করুক তারপর লেখুক।
— সে বয়স কি তার আছে? যা লেখতেছে লিখুক না। আমার কিন্তু খারাপ লাগে না তার লেখা। ‘অন্তর্মহলের নীল পিপিরা’ পড়েছিস গল্পটা। বেশ কিন্তু। কামরুল বলছিল তার বউও নাকি পড়েছে। বলল ভালোই লেখে।
-বাহ! তাইলে তো হইলই। স্বীকৃতি মিইল্যা গেছে। এখন ওর জামাইরেব দিয়া পত্রপত্রিকায় দিক, পুরস্কার আনুক। শুনছি তার জামাই খুব শেঠিয়া।
-না না তুই যা ভাবছিস তা নয়। নৈঋতা লেখাজোখার কথা জামাইরে কখনো বলেই না।
— ক্যান? তার জামাই তারে কত কি দেয়। সেবার না দেখাইল সিঙ্গাপুর থাইখ্যা বারো লাখ টাকা দামের ডায়মন্ডের আংটি দিছে!
-বাদ দে না। শত হইলেও আমাদের বন্ধু।
শেলী খুব শান্ত হয়ে যায়। লাবণীকে নরম সুরে বলে -তুই আবার ভাবিস না, আমি হিংসে করি। আসলে আমি ওর গল্পগুলো পড়ি। পঞ্চাশ বয়সটা খুব খারাপ রে। সব দিক দিয়ে ক্রাইসিস যায়। ধর যৌবন ঝরে যাওয়া। প্রৌঢ়ত্ব গ্রহণ করা। আর বার্ধক্য তো দরজার কাছে বসে থেকে টুকটুক করে লাঠি নাড়ে। ওর লেখা অন্তর্মহলের নীল পিপিরা নাড়া দেয়। জীবনটা নিয়ে ভাবিনি এতদিন। এখন মনে হয় আবার যদি পেতাম। ঘন সবুজ ঘাসের বিছানা। নীল আকাশের স্বাধীনতা। আহা! চলেই গেল।
লাবণী চমকে যায় শেলীর কথা শুনে। থাম থাম করে থামায়।
-দাঁড়া দাঁড়া আমি তো দেখছি তুইই কবি হয়ে যাচ্ছিস।
-আরে ধুর। কবি কি আর সবাই হতে পারে। শুনিস নাই জীবনানন্দ দাস কি বলেছিলেন-সবাই কবি হতে পারে না। কেউ কেউ হয়। আমি সেই কেউ এর মধ্যে পড়ি না। পাগলিটাকে বলিস লেখাগুলো আমাদের না পাঠিয়ে কোনো পত্রিকায় পাঠাতে। দুই একটা ছাপা হলে উৎসাহ পাবে।
-দুই তিনটা পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। ছাপায় নি। তার মধ্যে এক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক নাকি বলেছে এটা ছাপাখানা নয়।
-মানেটা কি? ওরা গল্প ছাপায় না?
—-ওরা ছাপা টার্মটা ব্যবহার করে না। তারা লেখা প্রকাশ করে।
-অর্থাৎ ছাপা ছাড়াই প্রকাশ করে? ওমা এতো দেখি আরেক কিসিম।
—-আসলে লেখতে গেলে কিছু শব্দের ব্যবহার জানতে হয়। নৈঋতা সেটা জানে না। এটাই বুঝাতে চাইল।
—-বাপরে! আচ্ছা রাখি রে লাবণী। চল পাগলটাকে নিয়ে কোথাও একদিন বসি। অনেকদিন ওর গান শুনি না। এত প্রতিভা ছিল মেয়েটার কিছু করতে পারল না। আমার মনে হয় কি লাবণী আমাদের জীবনটাই গল্পের মতো। সারাক্ষণ ই গল্পের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাই। কেউ দেখতে পাই কেউ পাই না।
—এই শেলী, তুইও কিন্তু ঐ লাইনেই যাচ্ছিস। দেখা গেল রিটায়মেন্টের পর নৈঋতার পেছন পেছন ঘুরছিস। গল্প খুঁজতে পার্কে বেরিয়েছিস। নৈঋতার বইয়ের নাম ‘নীল পিপিদের আস্তানা’ আর তর বইয়ের নাম হবে ‘পৌঁছে যাই গল্পের বাড়ি’। দুই বান্ধবীর মেসেজে তখন অতিষ্ঠ। বাথরুমে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। হা হা হা।
-যা : ফাজলামি করিস না। বাসায় যাবি কখন? তোদের তো ছুটি হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। মাস্টারিই এখনো মজার চাকরি রে। ছুটিছাটা অনেক বেশি। আর আমাদের, ছুটি তো দূরের কথা বাসায় যাও চাপ নিয়ে, সংসার কর চাপ নিয়ে, এমন কি জামাইয়ের সঙ্গে ঘুমাইতে যাও মাথায় চাপ নিয়ে।
-বাব্বা তাইলে শুইতে যাওয়ার কথাও মনে থাকে?
-তা তো থাকেই।
-হ্যাঁ রে শেলী, তোর মেনোপজ হয়ে গেছে?
—— মনে হয় হয়ে যাবে। ছয় মাসের মধ্যে দেখা নেই। কেন রে তোর হয়নি?
-একটা কথা ভাবি।
-কি?
-মেনোপোজ হলে কি সেক্স কমে যায়?
— কে বলেছে? একদম ফালতু কথা। একবিংশ শতাব্দী এসেও এসব বিশ্বাস করিস! শোন, মেনোপজ হলে বরং মজাসে ইয়ে করা যায় হা হা হা। তোর খবর কি?
-এইতো এখনো তেমন লক্ষ্মণ দেখি না। নিয়মিত পিরিয়ড হয়।
— তাহলে ভাবিস ক্যান? বাচ্চাকাচ্চার মা হওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি?
-ধুর যা কি যে কইস।
—— তাইলে হতাশা যে, বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে এখনো ঐসব নিয়া ভাবিস?
-কেন বয়স পঞ্চাশ হলে ঐসব নিয়ে ভাবতে নেই বুঝি? যৌবন হারাতে কে চায়? তোর মতো কাঠখোট্টা জীবনে দেখিনি। এই শোন, তুই আর যা হইস লেখক হইতে পারবি না। তোর মধ্যে একবিন্দুও রোমান্টিকতা নেই।
— গুষ্টি কিলাই তোর রোমান্টিকতার। তবে একটা কথা কইতে পারি।
— কি?
-হুম, এখন না। রহস্য!
-কি, কি বল না দোস্ত।
— না আজ না। আর একদিন বলব। অনেক কাজ পড়ে আছে। কি কথা বলতে এসে কি বলে গেলাম। শোন তোর কিন্তু এখনো চান্স আছে। ফাসিছ না। বুইড়া বয়সে দুধের ছাওয়াল।
-যা : শয়তান।
আজ আমি বাড়ি যাব না। স্কুল থেকে বের হয়ে মিরপুর দশের পথ ধরলাম। মাঝেমধ্যে উল্টাপাল্টা হাঁটতে ভালো লাগে নিজেকে পরিব্রাজক মনে হয়। দুনিয়াটা কত বড়। সংসার থেকে বের না হলে বুঝা যায় না। কলিগরা বলে আমরা ঘরের বাইরে কাজ করি। কলিগরা যাই বলুক সেই ঘর থেকে বের হয়ে তো ঘরের ভিতরেই কাজ করি। হাজারটা জটিলতা। কাউকে খুশি করা। কারুর বিরুদ্ধে লাগতে গিয়ে সত্য থেকে দূরে থাকা। কলহ তো কম নয়। হ্যাঁ তবে প্রাণ আছে। সকলের মাঝে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আজ আমার মেয়েটার এ লেভেল শেষ পরীক্ষা। এখন সাড়ে তিনটা বাজে পাঁচটায় পরীক্ষা শেষ। তার অনেক আগেই পৌঁছে যাব। মহম্মদপুর টোকিও সেন্টার। হাঁটলে বড়জোর একঘণ্টা লাগবে।
চলতে চলতে ফোন এল নৈঋতার। হন্তদন্ত কণ্ঠস্বর।
-দীপা বাজে একটা কাহিনি হয়ে গেছে রে এখন কী হবে?
-মানে কি, কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?
-সর্বনাশ হইছে।
-হেঁয়ালি রাখ। কি হইছে খুলে বল?
-ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে।
-দেখ নৈঋতা, এই জন্যেই না কেউ তোকে পছন্দ করে না। সব কিছু নিয়েই অতিরিক্ত করিস।শান্ত হয়ে বল কি হয়েছে। পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছে?
-না
-তাহলে?
-ইমরান টের পেয়ে গেছে আমি লেখালেখি করি।
-তো?
-সে চায় না আমি লেখি। তুই জানিস না সে আমার কবিতার খাতা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল! আমার ননদও তাল দিয়েছিল। বলেছিল আমি নিশ্চয়ই কারুর প্রেমে পড়েছি। নইলে জন্মান্ধ প্রেমিক কাকে বলি।
-আশ্চর্য! তোর ননদ এত সাহস পায়?
-তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও কমপ্লেইন দিয়েছিল। কবিতার মধ্যে নাকি এমনই ইঙ্গিত আছে।
ছি: ছি:। অশিক্ষিত নাকি?
-শোন দীপা, এইবার আমার লেখা বন্ধ করে দিলে আমি কিন্তু বাঁচব না। বলে রাখলাম তোকে। আমি বাকি জীবন এটা নিয়ে কাটাতে চাই।
নৈঋতার কান্না আমার হৃদয়টাকে দুমড়েমুচড়ে দিল। আহা নারী অন্তরালে কত কান্না জমা রেখে গল্পের ভেতর হাঁটে। টোকিও সেন্টারের সামনে মানুষের ভিড়। অপেক্ষাকৃত গার্ডিয়ান। মানুষের ভেতর মানুষ খুঁজছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে মার্কেটের শেষ মাথায় চলে এলাম। দেখলাম দুই ভুরুর মাঝখানে মোটা ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই দৃশ্যের পরবর্তী সংলাপ নৈঋতার গল্পের ভেতর আছে। গল্পটা আমি পড়েছি। গল্পটা অন্তরালে ঘুরে বেড়ায়।