
নবাব সিরাজউদ্দৌলা
সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় আরোহণ করেই এই ১৪ মাস ১৪ দিনের মধ্যে পূর্ণিয়া থেকে কলকাতা হয়ে পলাশীর প্রান্তর পর্যন্ত কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে। পাঁচ পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে। চর্তুদিকে অসংখ্য যড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়েছে। তাঁকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুত গতিতে পথ চলতে হয়েছে। দিন কাটাতে হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে, অশ্বপিষ্ঠে, রাত কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে
বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু দিন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই তাঁকে হত্যা করা হয়।
১৭৩৩ সালে সিরাজউদ্দৌলা জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জয়নুদ্দিন আহমদ খান ও মাতা আমেনা বেগম। সিরাজউদ্দৌলার শিক্ষাজীবন কেটেছে তাঁর পিতামহের গৃহে। তাঁর পিতা ছিলেন বিহারের গভর্নর। আলীবর্দী খানের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় তার প্রাণপ্রিয় নাতি সিরাজউদ্দৌলাকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান মৃত্যুবরণ করলে সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২৩ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজত্বকাল ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬ সাল থেকে ২৩ জুন ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিন।
সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতা গ্রহণের আগে মাতামহ নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুশয্যায় পবিত্র কোরআন স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি কখনো মদ্যপান করবেন না এবং ইংরেজদের প্রশ্রয় দেবেন না। আমৃত্যু তিনি সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন।
কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় আরোহণ করেই এই ১৪ মাস ১৪ দিনের মধ্যে পূর্ণিয়া থেকে কলকাতা হয়ে পলাশীর প্রান্তর পর্যন্ত কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে। পাঁচ পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে। চর্তুদিকে অসংখ্য যড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়েছে। তাঁকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুত গতিতে পথ চলতে হয়েছে। দিন কাটাতে হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে, অশ্বপিষ্ঠে, রাত কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে। নানাজীর উদ্যোগে সেই অল্প বয়সে বিবাহিত সিরাজের তখন আপন স্ত্রী লুৎফা, শিশুকন্যা জোহরারও প্রতি ফিরে তাকাবারও তো তাঁর কোনো ফুরসৎ ছিল না।
নাটকের আলেয়া নাস্নী আর্য সুন্দরীদের মোহাবিষ্ট জ্বালে রূপাক্লিষ্ট পতঙ্গের মতো লাম্পট্যলীলায় সময় কাটাবার মতো অবসর তিনি পেলেন কোথায়? এগুলো আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে আজ অবশ্যই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে উপবিষ্ট হওয়ার পর থেকে তাঁর নিকটাত্মীয়রা তাঁকে মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে তাঁকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে নবাব হওয়ার উচ্চাশা করেছিলেন তাঁর অন্যতম আত্মীয় এবং প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান। কাশিমবাজার কুঠিতে নবাবকে উৎখাত করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘষেটি বেগম, ইয়ার লতীফ খান, জগৎ শেঠ, রাজা রাজ বল্লভ, রায় দুর্লভ, মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র, খাদিম হোসেন, ওয়াটস এবং প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান, সিংহাসনে আরোহণ করার পর থেকে তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ সৃষ্টি হয়।
এক পর্যায়ে কাশিম বাজার কুঠিতে যে সব চক্রান্তকারী নবাবের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিও হাত মেলায়। সেখানে মীর জাফরের সঙ্গে ক্লাইভের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ অনিবার্য হয়ে ওঠে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হলো। কিন্তু গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ চক্রান্তকারী মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করে যুদ্ধের ময়দানে পুতুলের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১১ টা ৩০ মিনিট মাত্র এক ঘণ্টার প্রহসন যুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের সব সৈন্যদল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। একে যুদ্ধ বলা যায় না বরং বলা যায় যুদ্ধের একটা মহড়া। এই খ-যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩২০০ সৈন্যের কাছে সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজার সৈন্যের অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। ক্লাইভের সৈন্যরা পরবর্তীতে রাতের আঁধারে আকস্মিক আক্রমণ করলে নবাব বাহিনী দিশেহারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
ফলে অসহায় নবাব পরাজিত হয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। অথচ ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন- পলাশীর যুদ্ধের বাইরে যেসব কৃষক ও আমজনতা দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল তারা যদি হাতে ইট ও ঢেলা নিয়ে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের প্রতিরোধ করবার জন্য আক্রমণ করতো তবে কখনোই পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়ী হওয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হতো না। কিন্তু হতভাগ্য এদেশের সাধারণ মানুষ পলাশীর যুদ্ধে এগিয়ে আসেন নাই। তাদের তখন রাজনৈতিক সচেতনতার বড়ই অভাব ছিল। পরবর্তীতে পুনরায় যুদ্ধ করার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা স্ত্রী, কন্যাসহ নৌকাযোগে পাটনার উদ্দেশে যাত্রা পথে ভগবান গোলায় মীর কাশিমের সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে জাফরগঞ্জের এক নিভৃত কারাগারে আটক রাখা হয়।
পরে ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই আজকের দিনে মীর জাফরের পুত্র মীরণের আদেশে ঘাতক মোহাম্মদী বেগ তার নাঙ্গা তলোয়ার দিয়ে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারপর সিরাজউদ্দৌলার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরানো হয়েছিল। নবাবের মা’ আমেনা বেগম নবাব পরিবারের সকল ঐতিহ্য ভেঙে ছেলের লাশ দেখার জন্য রাস্তায় নেমে আসলে ঘাতকরা তাঁকে লাঠি পেটা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। হাতিটা কিন্তু সিরাজের লাশ নিয়ে আমেনা বেগমের কাছে বসে পড়ে। শেষ পর্যন্ত নবাবের খ-বিখ- লাশ ময়লার স্তূপে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু মির্জা জয়নুল আবেদীন নামক এক সহৃদয় ব্যক্তি মীর জাফরের অনুমতি নিয়ে পরম শ্রদ্ধাভরে লাশের টুকরোগুলো ভাগিরথীর জলে পরিষ্কার করিয়ে নদীর ওপারে খোশবাগের শাহী কবর খানায় নবাব আলীবর্দী খানের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করেছিল। নবাবের পাশে তাঁর কন্যা জোহরার কবর। নবাবের পদতলে আছে প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফার কবর।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু (১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই মৃত্যু) আজ ২৬৪ বছর অতিক্রম করল। তারপরও নবাবের সমাধি ক্ষেত্র মুর্শিদাবাাদের খোশবাগ আজও মানুষকে আকর্ষণ করে। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন মহান দেশপ্রেমিক, সাহসী যোদ্ধা, বিজ্ঞ রাজনীতিক এবং একজন আদর্শবান ও বলিষ্ঠ নবাব। নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে ১ ঘণ্টার প্রহসন যুদ্ধে পরাজিত হন ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। তাঁর এই করুণ মৃত্যু জাতিকে বার বার বেদনাহত করে।