
উপন্যাস: ফিরে আসা ছায়া
রায়হানের চারপাশটা যেন ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে।
যে সত্য একসময় কুয়াশার মতো ছিল,
তা এখন যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যায়
তবু সে জানে, একবার ছুঁয়ে ফেললে ফিরতে পারা যাবে না।
চিঠির শেষ লাইন আর সেই ছায়ার মতো কণ্ঠ
তার মনকে তোলপাড় করে তুলেছে।
“তোমারই লেখা উচিত চিঠির শেষ লাইন।”
মানে কী?
সে কি একজন উত্তর খোঁজার মানুষ,
না কি সেই খেলোয়াড় যে নিজেও জানে না সে খেলায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে?
পরদিন ভোর।
রায়হান অফিসে না গিয়ে চলে গেল মোহাম্মদপুরে।
সেখানে থাকতেন একসময় সায়রার খালামনি,
একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা, যিনি সায়রাকে নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছিলেন।
এই তথ্য সে পেয়েছিল পুরনো এক ফেসবুক পোস্ট থেকে।
পোস্টে সায়রার জন্মদিনের ছবি ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে সেই খালামনি।
রায়হান কড়া নাড়ল দরজায়।
একজন বয়স্ক নারী দরজা খুললেন।
চোখে ক্লান্তি, কণ্ঠে এক ধরনের বিষণ্ণতা।
“আপনি কি সায়রার খালামনি?”
রায়হান বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল।
নারীটি চমকে উঠে তাকাল।
“তুমি কে?”
“আমি রায়হান। সায়রার বন্ধু ছিলাম। ওর সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।”
নারীটি প্রথমে চুপ।
তারপর ধীরে ধীরে বললেন
“সায়রাকে নিয়ে কথা বলার মতো কেউ বাকি নেই রে বাবা।
ওর জীবনটা খুব ছোট ছিল, অথচ কত বড় ঝড় নিয়ে এসেছিল।”
চা খেতে খেতে রায়হান জানতে পারল অনেক কিছু।
সায়রা ছিল প্রচণ্ড মেধাবী, কিন্তু ভেতরে ছিল প্রচণ্ড আবেগী।
তাসনিম ছিল তার ক্লাসমেট, একমাত্র বান্ধবী যাকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করত।
কিন্তু হঠাৎ করেই তাসনিমকে নিয়ে সে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।
“তাসনিম কোথায় যেত, কার সঙ্গে মিশত, কী যেন খুঁজছিল সায়রা বুঝতে পারত না।”
খালামনি বললেন, “এক রাতে ও খুব কাঁদছিল।
বলছিল, ‘আমি যদি তাসনিমকে না বাঁচাতে পারি, তবে আমি নিজেও হারিয়ে যাবো।’”
“এরপর?”
রায়হানের গলা শুকিয়ে গেল।
“তারপর, একদিন ওর ফোনটা বন্ধ।
বাসায় ফেরেনি।
তিন দিন পর ও ফিরে এল...
কিন্তু...”
“কিন্তু কী?” রায়হান প্রায় চিৎকার করে উঠল।
“তাকে আর আগের সায়রা বলা যেত না।
চোখ দুটো ছিল ফাঁকা, আর চুপচাপ।
যেন তার ভেতরের কেউ চলে গেছে।”
“তারপর একদিন হঠাৎই... নিখোঁজ।
আজও সে ফেরেনি।”
রায়হান বুঝল তাসনিমের রহস্যের গভীরে সায়রা একসময় ঢুকেছিল,
কিন্তু তার পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ।
হয়তো সায়রাই তাসনিমকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যায়।
কিন্তু এখন?
সে কি মৃত?
না কি সেই ছায়ার মাঝেই রয়ে গেছে জীবিত, অথচ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে?
বাড়ি ফিরে এসে রায়হান আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
এবার সে মুখোশ ছাড়া, মুখোমুখি নিজেই।
সে আত্মবিশ্লেষণ করে
সে কি আসলে তাসনিমকে খুঁজছে?
না কি সে সায়রাকে বাঁচাতে চাইছে?
নাকি সে নিজের মুখ খুঁজে ফিরছে,
যেটা হারিয়ে গেছে মুখোশের ভিড়ে?
ঠিক তখনই তার ফোনে মেসেজ এল
একটি ছবি।
ছবিতে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার সেই গলিতে।
হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ভিজে পা, সাদা কুর্তি, লাল ওড়না।
পেছনে ছায়া পড়ে আছে।
ছবির নিচে লেখা
“সায়রা এখনো দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায়।
তুমি কি এবার সত্যি ফিরে যাবে?”
রায়হান এবার সিদ্ধান্ত নিল
সে ফিরে যাবে।
শেষবারের মতো।
আর এবার সে শুধু দেখতে নয়, জানতে যাবে।
লেখক: মো আইয়ুব মন্ডল
ইমরান