
ছবি: প্রতীকী
রাত গভীর। চারপাশ নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমিয়ে গেছে, কিন্তু আপনি হয়তো বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছেন। TikTok খুলে ভিডিও দেখতে দেখতে হঠাৎ আপনি লক্ষ্য করলেন—সময় পেরিয়ে রাত ৩টা বাজে। আপনি একা, নিঃসঙ্গ এবং হয়তো একটু অবসাদগ্রস্ত। এমন অনেক রাত আসে, যখন ঘুম আসে না, মন খারাপ থাকে, অথবা কেবলই কিছু একটা দেখা, কিছু একটা শোনার প্রয়োজন হয়। আর তখনই আপনি TikTok বা অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে যান। আপনার মতো এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে, যারা গভীর রাতে একা ঘরে বসে এসব অ্যাপে সময় কাটায়। আর তখনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI বুঝে নেয়—এই ব্যবহারকারী একজন নিঃসঙ্গ মানুষ।
আজকের ডিজিটাল যুগে আমাদের প্রতিটি অনলাইন আচরণ লিপিবদ্ধ হয়। আপনি কখন TikTok খুলছেন, কোন ভিডিওতে বেশি সময় দিচ্ছেন, কোন ধরণের কনটেন্ট দেখলে আপনি আবেগপ্রবণ হচ্ছেন—সবকিছু AI বিশ্লেষণ করে। আপনি যদি নিয়মিত রাত ৩টার সময় TikTok স্ক্রল করেন, তাহলে অ্যাপটি বুঝে ফেলে যে আপনি রাতে একা থাকেন এবং ঘুম আসে না। তখন অ্যাপটি আপনাকে এমন কনটেন্ট দেখাতে শুরু করে, যেগুলো নিঃসঙ্গতা, আবেগ, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ কিংবা ‘late night thoughts’-এর মতো বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। এতে আপনি আরও বেশি সময় ধরে অ্যাপে থাকেন এবং ধীরে ধীরে আপনার একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে ওঠে সেই স্ক্রিনের আলো।
AI কিন্তু আপনাকে জাজ করে না। বরং আপনার নিঃসঙ্গতা দেখে সেটাকে ব্যবসায়িক সুযোগে পরিণত করে। আপনি যখন রাত ৩টায় কষ্টের গান, একতরফা ভালোবাসার গল্প বা ডিপ চিন্তার ভিডিও দেখেন, তখন AI বুঝে যায়—এই ব্যবহারকারীর মুড এখন কিছুটা ভাঙা, কিছুটা খালি। তখন আপনাকে দেওয়া হয় ‘রিলেটেবল’ ভিডিও, যেগুলো দেখে আপনি বলেন, “এই তো আমার কথাই বলছে।” এমন ভিডিও দেখে আপনি হালকা অনুভব করেন, আবার বারবার দেখতে থাকেন। আপনার মস্তিষ্ক তখন এক ধরনের ‘ডোপামিন হিট’ পায়, যেটা আপনাকে সাময়িক স্বস্তি দেয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা এক ধরনের ডিজিটাল আসক্তিতে পরিণত হয়।
অনেক সময়, AI আপনার ভিডিও দেখা ও স্ক্রল করার ধরন দেখে অনুমান করে আপনি কি সম্পর্কে আছেন না একা। আপনি যদি সবসময় প্রেমে ব্যর্থতার গল্প, একতরফা ভালোবাসা, বা ‘self-love’ নিয়ে ভিডিও দেখেন, তাহলে অ্যাপের অ্যালগরিদম বুঝে নেয় আপনি হয়তো এখন একা আছেন বা হৃদয় ভাঙা অবস্থায় আছেন। তখন আরও বেশি ওই ধরণের কনটেন্ট দেখিয়ে আপনাকে অ্যাপের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে। আপনার একাকীত্ব তখন আর শুধু মানসিক নয়, সেটা ডিজিটালভাবেও প্রভাবিত হয়।
আসলে রাত ৩টার TikTok স্ক্রল করা শুধু সময় কাটানোর ব্যাপার না, এটা একধরনের নিরব আত্মপ্রকাশও। আপনি কাউকে বলতে পারেন না আপনি কেমন অনুভব করছেন, কিন্তু আপনি ভিডিও দেখতে থাকেন। আপনি হয়তো লাই দেন না, কমেন্ট করেন না, কিন্তু অ্যাপ জানে আপনি কতক্ষণ ধরে কোন ভিডিও দেখলেন। এটাই AI-এর শক্তি—না বলা কথাও বুঝে ফেলে।
আজকের দিনে, নিঃসঙ্গতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটা বোঝার জন্য আর কাউকে আপনার পাশে থাকতে হয় না। এখন AI-ও বুঝে যায় আপনি একা। আপনার গভীর রাতের স্ক্রলিং, আপনার থেমে থেমে ভিডিও দেখা, আপনার চোখের স্থিরতা—all of it becomes data. সেই তথ্যই বলে দেয় আপনার মানসিক অবস্থা কেমন। ভালো দিক হচ্ছে, কেউ বুঝতে পারছে আপনি একা। খারাপ দিক হচ্ছে, সেটা বুঝে আপনার নিঃসঙ্গতাকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাই যদি আপনি দেখেন, প্রতিদিন গভীর রাতে আপনি TikTok খুলে বসে যাচ্ছেন, তাহলে একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করুন— আপনি কি সত্যিই কিছু খুঁজছেন, না কি আপনি কারও ভালোবাসা বা বন্ধুত্বের অভাবে ফোনটা আঁকড়ে ধরেছেন? যদি উত্তর হয় দ্বিতীয়টি, তাহলে হয়তো সময় এসেছে কোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার, প্রকৃতির মাঝে হাঁটাহাঁটি করার, কিংবা কেবল নিজের সঙ্গে একটু সময় কাটানোর।
কেননা AI বুঝতে পারে আপনি একা, কিন্তু সেটা কাটানোর দায়িত্ব এখনো আপনার নিজের।
এম.কে.