ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৃষক বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ 

আবু সাইদ কামাল

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ৮ জুন ২০২৩

কৃষক বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ 

বাংলাদেশের উপন্যাস

বাংলাদেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে বড়ো বাঁকবদল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বসভায় আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশ একাত্তর সালে স্বাধীনতা লাভ করলেও জাতি হিসেবে বাঙালি জাতির উন্মেষ ও বিকাশ হাজার বছরের পুরনো। 
প্রাচীনকালে বাংলা বরেন্দ্র, বঙ্গ, রাঢ়, পু-্র সমতট, হরিকেল, গৌর, চন্দ্রদ্বীপ প্রভৃতি নামের জনপদে বিভক্ত ছিল। সর্বপ্রথম ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ দিল্লির অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাজ্য গঠন করেন। তিনি এতদঞ্চলের বিভিন্ন জনপদকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘বাঙ্গালা’ নামকরণ করেন। ইতিহাসে তাঁকে ‘শাহী বাঙ্গালা’ নামে অভিহিত করা হয়। ১৫৭৬ সালে মোগল রাজশক্তি রাজমহলের যুদ্ধে আফগান বংশোদ্ভূত পাঠান নৃপতি দাউদ কররানিকে পরাজিত করে বাংলায় নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। বাঙ্গালার নতুন নামকরণ করেন সুবা বাংলা। এভাবে ধীরে ধীরে বাংলা একটি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে পরিণতি পায়।
একটি জাতির হাজার বছরের নির্মাণ প্রক্রিয়া পরবর্তীতে সাহিত্যে কিভাবে প্রতিফলিত হয়, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ৪৭ পরবর্তী সময় পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও রেনেসাঁসের নতুন বিকাশ ঘটে। এই ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কৃষক বিদ্রোহ ও ভাষা আন্দোলনকে বিষয়বস্তু, প্রেক্ষাপট ধরে বেশ কিছু উপন্যাস লেখা হয়। আবার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কৃষক বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহকে কেন্দ্র করে অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে। এ সকল উপন্যাসকে ভিত্তি ধরে সোহেল মাজহারের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের উপন্যাস কৃষক বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ’।

সোহেল মাজহার তাঁর প্রবন্ধে উপন্যাসের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, শিল্পশৈলী, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও চরিত্রের মানস জগত উন্মোচনের পাশাপাশি ইতিহাসের প্রেক্ষাপট, ধারাবাহিকতা ও কার্যকারণ বিশ্লেষণ করেছেন। ইতিহাস কিভাবে জাতিসত্তা বিনির্মাণ করে লেখক এই বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন এভাবে, ‘কৃষক বিদ্রোহের পেছনে অতিরিক্ত করের বোঝা যেমন ছিল তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় আবেগ, আঞ্চলিক স্বাধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা এবং স্বজাতিবোধও কাজ করেছিল। সেই সময় কৃষক শ্রেণি কিংবা বৃহত্তর জনমানুষের মধ্যেও আধুনিক জাতীয়তা বোধের ধারণা জন্মলাভ করেনি, ব্যাপক অর্থে বিকশিত হয়নি। কিন্তু এ কথা আজ স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত কৃষক আন্দোলনের মধ্যেই স্বাধিকার চেতনা ও জাতীয়তা বোধের বীজ নিহিত ছিল’। [পৃ: ১৭] লেখক তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে ড. আবদুল বাছিরের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবে ফলে বাংলার কৃষককে একাই সংগ্রাম করতে হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে।

এই রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে ঔপনিবেশিক সরকার, রাষ্ট্রসৃষ্ট জমিদার- সকল মধ্য শ্রেণি এবং নানাস্তরের পত্তনিদারকে। তারা সবাই ছিল কৃষকের প্রতিপক্ষ। তাদের মিলিত শক্তি ছিল কৃষক বিদ্রোহীদের অধিক।  ফলে বিদ্রোহে কৃষক শ্রেণির তাৎক্ষণিক সাফল্য ছিল ক্ষীণ। কিন্তু যে বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এক অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহের প্রভাব পড়েছিল অন্য অঞ্চলের বিদ্রোহে। ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহ এবং ১৮৫৯- ৬১ সালের নীল বিদ্রোহে ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণই এর প্রমাণ। আর এ সকল বিদ্রোহের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছিল এ দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে সন্দেহ নেই।

এ অর্থে বাংলার কৃষক বিদ্রোহই ছিল আমাদের জাতীয়তা বোধ উন্মেষের প্রাথমিক উপকরণ। ‘যদিও আধুনিক অর্থে জাতীয়তা বোধ বলতে যা বুঝায় সে ধরনের জাতীয়তাবাদে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বাংলার কৃষকশ্রেণি অবতীর্ণ হয়েছিল এ দাবি অবশ্যই করা যাবে না’। [পৃ: ১৮] 
লেখক আলোচ্যগ্রন্থে কৃষক বিদ্রোহ ও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ৯টি উপন্যাসকে আলোচনায় এনেছেন। একইভাবে তিনি ভাষা আন্দোলন পর্বে ৬টি, গণ-অভ্যুত্থান পর্বে ৫টি ও মুক্তিযুদ্ধ পর্বে অন্তত ৮০টি উপন্যাস আলোচনায় এনেছেন। লেখক সোহেল মাজহার বিভিন্ন উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ ও প্রতিবেশ কিভাবে আমাদের কৃষক বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিফলিত করেছে সেই দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। 
বাংলাদেশের উপন্যাস কৃষক বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অবসর প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছেন জাওয়াদ উল আলম। মূল্য- ৭৫০ টাকা। 
বইটির ব্যাপক পাঠ ও বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।

×