ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বহুধাবিস্তৃত কাব্য নিরীক্ষা

হাসান হাফিজ

প্রকাশিত: ০১:৪২, ২৫ নভেম্বর ২০২২

বহুধাবিস্তৃত কাব্য নিরীক্ষা

.

আগেরকালে যখন কবিতা সুর করে পাঠ করা হতো জটলায়, সমাবেশে, তখন একটি লাইন ঘুরে ঘুরে আসত। ধুয়া বলা হয় তাকে। নবীন কবি জান্নাতুন নিসার ‘সত্যিই কি কিছু আছে’ কাব্যগ্রন্থে সেই ধুয়ার প্রত্যাবর্তন আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করি। ছয় ফর্মার এই গ্রন্থশরীর-একটি কবিতায়ই প্রলম্বিত হয়েছে। প্রখর স্রোতস্বিনী কোনো মহানদী যেমন অজস্র শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত বিভক্ত ও প্রবাহিত হয় ঠিক তেমনি। কিংবা বলতে পারি, একটি মহীরূহের যেমন অগুনতি ডালপালা থাকে, (বড় ছোট মিলিয়ে) সে রকম বিস্তার ও বৈচিত্র্যসুন্দরতা।
আধুনিক মানুষ মাত্রই সংশয়প্রবণ, দ্বান্দ্বিকতা তার সহজাত চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য। সঙ্গত কারণেই কবিও প্রশ্নপ্রবণ হবেনÑ এরকমটা হতেই হবে তাকে। কেননা কবিরা তো সত্যদ্রষ্টা,স্বাপ্নিক ও আশা ভরসার আলোর উৎস। প্রশ্নকাঁটায় তিনি বিদ্ধ করেন সমাজ-সংসার-জগতের নানা অনিয়ম অনাচার অসঙ্গতি। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বাণে তিনি জর্জরিত করেন যাবতীয় শোষণ-নিপীড়ন পাপাচার বৈকল্য এবং কূট অস্বাভাবিকতাকে।
কবি বলেছেন,
সংঘাত বলে কি সত্যিই কিছু আছে
নাকি সবটাই কেবল
আমাদের শাণিত অনুভূতির কড়িকাঠে
গড়া অধিদেবতা?
অন্যত্র আমরা পাচ্ছি,
যুদ্ধ বলে কি সত্যিই কিছু আছে
নাকি সবটাই কেবল
আমাদের নগ্ন প্রবঞ্চনার নেশা
দোদুল্যমান অবসানতা?
বরেণ্য কবি অসীম সাহা ‘সত্যিই কি কিছু আছে ’বইটির ভূমিকা লিখেছেন। কবিচারিত্র্য তিনি গভীর মমতায় শনাক্ত করেছেন, ভূমিকায় বিশ্লেষিত হয়েছে উদীয়মান এই কবির মানসগঠন ও কবিতা। বাংলা কবিতার আবহ ঐতিহ্যের নিরিখে তিনি কবি জান্নাতুন নিসার অবস্থান পর্যবেক্ষণ ও স্থান নির্ধারণ করেছেন। কবি অসীম সাহা লিখেছেন-
‘আপাতভাবে তার কবিতাটিকে জটিল বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তার অন্তর্গূঢ় রহস্য উন্মোচন করতে পারলে পাঠক এর মধ্যে খুঁজে পাবেন জীবনের নানামুখী প্রশ্ন ও তার উত্তর। এই শ্রমসাধ্য কবিতার প্রতিটি স্তবক ও পঙ্ক্তিতে ব্যক্তিক চরিত্র, সামগ্রিক জীবনাচরণ, সময় ও কাল এবং ভাষাবিন্যাসের যৌক্তিকতাসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন। আছে সেই প্রশ্নের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক উত্তর। এই কাজটি করতে গিয়ে কবি নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এ-ধরনের কাজে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়।
নতুন কিছু করতে গেলে সেই অনিবার্যতার পথের অনুসারী না হয়ে উপায় নেই। এতে পতনের সম্ভাবনা থাকে বলে অনেক কবিই তা না করে গতানুগতিক পথের দিকেই তাদের অভিসারকে অব্যাহত রাখেন। তাতে কৌলিন্য রক্ষা হয় বটে, কিন্তু নতুন কাব্যিক অভিযাত্রা সম্ভব হয়ে ওঠে না। জান্নাতুন নিসা এ-ব্যাপারে ঝুঁকি নিয়েছেন। শুধু চিন্তার ক্ষেত্রে নয়, ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। ক্রিয়াপদে যেমন, তেমনি বিশেষ্যকে অব্যবহৃত নতুন বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও নিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। এটা কবিদের অধিকার।’
আবার আমরা কবিতার দিকে যাব। দৃকপাত করব ক্ষণিক। কবি জান্নাতুন নিসা বলেছেন,
যাযাবর বলে কি সত্যিই কিছু আছে
নাকি সবটাই কেবল
আমাদের সহিংস খঞ্জরের আদি ভান্ডার ছেঁড়া
অধিকারহীন সংস্কৃতির অকপটতা?
জান্নাতুন নিসার প্রশ্নের ক্ষেত্র পরিধি বিশাল। নিত্য জীবনের অনেক কিছুই আমরা সাধারণ চোখে দেখি। এসব খুঁটিনাটি  দেখলেও আমাদের মনে কোনো প্রশ্নের উদয় হয় না। কিন্তু এই কবি তার পরিপার্শ্ব, নিত্যদিনের চেনাজানা জগত, বোধ, উপলব্ধি, জিজ্ঞাসাকে লালন করেন, সবকিছুই তিনি দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, কেন কী ঘটেছে, কীভাবে ঘটছে এসবের কার্যকারণ অনুসন্ধানে ব্রতী ও নিবিষ্ট মনোযোগী হয়ে ওঠেন। অজস্র প্রশ্নের হলো তাকে সদাসর্বদা বিদ্ধ করে, সম্ভাব্য উত্তর খুঁজতে খুঁজতে তিনি পরিত্রাণের ও সিদ্ধান্তের পথ খোঁজেন।  
কবি জান্নাতুন নিসা যেসব বিষয়ের গূঢ় অর্থ আবিষ্কারের প্রয়াসী-তার মধ্যে রয়েছে আকাশ, প্রতিবিম্ব, স্পর্শ, সংযম, যুদ্ধ, প্রতিদ্বন্দ্বী, সংসার, ভয়, রহস্য, পথ, দ্বিধা, ক্রোধ, স্বপ্ন, সাহস, প্রত্যাখ্যান, করুণা, মৃত্যু, নিয়ম, পাপ, স্বভাব, প্রেম, বিপ্লব, বন্ধন, সময়, জ্যোৎস্না, ব্রহ্মা-, ক্ষমা, দুঃখ, বন্দনা, অনুভব ইত্যাদি।
বিপ্লবকে কীভাবে দেখছেন কবি? বলছেন তিনি,
বিপ্লব বলে কি সত্যি কিছু আছে
নাকি সবটাই কেবল
আমাদের নদীর মতন
চিৎকার ভাঙা অহেতুকতা?
কবি জান্নাতুন নিসা আরো পাঠ, পর্যবেক্ষণ ও অধ্যবসায়ের পরিণতি হিসেবে আরও পরিপক্ব কবিতা অদূর আগামীতে আমাদের উপহার দেবেন, তার কাব্যানুশীলন আরও পরিণতি লাভ করবে ক্রমান্বয়ে, এই প্রত্যাশা রইল। তার পরীক্ষাধর্মিতা প্রশংসনীয়, সূক্ষ্ম অবলোকন অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কবির কথার খানিক উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই এই লেখা। ‘সময়ের কথকতা’ শিরোনামের আত্মকথনে তিনি বলেছেন,
‘কালের আয়নায় যুগ যুগ ধরে কবিতায় আমরা যেমন পেয়েছি কবির চঞ্চল বসন্তের বিবর্ণ অনুভূতি, তেমনি পেয়েছি অগ্নিস্নানে দগ্ধ সময়ের কাকভেজা উপলব্ধি। আবার অবিশ্বাসী সময়ের ক্লান্ত রূঢ়তায় ভর করে বর্ষণমুখর ভাদ্দরেও কবিতা পেখম মেলেছে প্রকৃতি-প্রেম-বিরহ-সংগ্রাম-দেশ-যুদ্ধ-স্বাধীনতার অনিন্দ্য প্রত্যাশায়। প্রত্যাশিত সেই উচ্চারণের পড়ন্ত সময়ের সূচনালগ্নে ব্যস্ততা অবলম্বনের সংক্ষিপ্ত রূপে রচিত ‘সত্যিই কি কিছু আছে’ নামের আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কড়া নাড়ছে বাংলা সাহিত্যভুবনে। বলা চলে, ভাব ও চিন্তায় নিমগ্ন থেকে অনেকটা সর্বাধিক প্রচলিত কিংবা অপ্রচলিত, একেবারে নতুন, সর্বজনবিদিত অথচ অব্যবহৃত বা প্রায় ব্যবহৃত শব্দ প্রয়োগের জানা অজানা ছন্দ অনিবার্য মূল্যায়নের ভাবার্থে বাক্যের বিন্যাস ঘটিয়েছি আপন মনে।....’

 

×