ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

সকালে ঘুম ভাঙার পর গলা খারাপ থাকার কারণ ও প্রতিকার

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৮ জুলাই ২০২৫

সকালে ঘুম ভাঙার পর গলা খারাপ থাকার কারণ ও প্রতিকার

ছ‌বি: প্রতীকী

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকেই লক্ষ্য করেন যে গলা খারাপ লাগছে, গলা খুশখুশ করছে বা স্বর বসে গেছে। এমনকি কখনো কখনো গলা ব্যথা, শুকনোভাব, কিংবা কফ জমে থাকার অনুভূতিও হয়। এই ধরনের সমস্যাগুলো খুব সাধারণ হলেও, অবহেলা করলে দীর্ঘমেয়াদে তা জটিল রূপ নিতে পারে। সকালে ঘুম ভাঙার পর গলা খারাপ থাকার বেশ কিছু কারণ রয়েছে, এবং সেগুলো জানা থাকলে প্রতিকার গ্রহণ করা সহজ হয়।

সবার আগে যেটা বুঝতে হবে, তা হলো রাতের ঘুমের সময় শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ কিছুটা ভিন্ন থাকে। শরীর একপ্রকার বিশ্রামের অবস্থায় থাকে, ফলে লালা নিঃসরণ কম হয়, নাক দিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার বদলে অনেকে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেন, ঘর যদি শুষ্ক হয় তবে বাতাসে আর্দ্রতা থাকে না। এসব কিছুর সমষ্টি মিলে গলার শ্লেষ্মা শুষ্ক হয়ে যায়, গলা শুষ্ক ও রুক্ষ অনুভব হয়।

শুষ্ক বায়ু গলার জন্য অন্যতম ক্ষতিকর উপাদান। অনেক সময় ঘরের এসি বা ফ্যান সরাসরি গায়ে লাগলে ঘরের আর্দ্রতা কমে যায়, ফলে ঘুমের সময় গলার শ্লেষ্মা শুকিয়ে যায়। তাছাড়া শীতকালে বা গরমে অতিরিক্ত ধুলাবালি থাকলে বাতাস আরও শুষ্ক হয়ে পড়ে, যা গলায় খুশখুশে ভাব বা অস্বস্তির সৃষ্টি করে।

আরেকটি সাধারণ কারণ হলো সাইলেন্ট রিফ্লাক্স বা ল্যারিঞ্জোফ্যারিঞ্জিয়াল রিফ্লাক্স (LPR)। এ অবস্থায় পাকস্থলির অ্যাসিড রাতের বেলায় গলা পর্যন্ত উঠে আসে, কিন্তু স্বাভাবিক অ্যাসিড রিফ্লাক্সের মতো বুকজ্বালা হয় না বলে অনেকেই ধরতে পারেন না। বরং সকালে উঠে গলা খুসখুসে লাগে, স্বর ভেঙে যায়, মনে হয় গলায় কিছু আটকে আছে— এসবই সাইলেন্ট রিফ্লাক্সের লক্ষণ।

রাতের খাবার খুব দেরিতে খাওয়া, অতিরিক্ত ঝাল বা তেলযুক্ত খাবার খাওয়া, কিংবা শোবার ঠিক আগে পানীয় গ্রহণ করলে রিফ্লাক্সের ঝুঁকি বাড়ে। এমনকি মোটা মানুষদের বা যাদের ওজন বেশি, তাদের ক্ষেত্রে পেটের চাপ গলায় অ্যাসিড ঠেলে উঠিয়ে দিতে পারে।

নাক বন্ধ থাকাও একটি বড় কারণ। অনেকে এলার্জি, ঠাণ্ডা বা সাইনাসজনিত কারণে নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতে পারেন না এবং মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেন। মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিলে মুখ ও গলা শুকিয়ে যায়, ফলে গলায় ব্যথা বা অস্বস্তি দেখা দেয়। এটি শিশুদের মধ্যেও অনেক বেশি দেখা যায়।

অ্যালার্জিও গলার খারাপ হওয়ার আরেকটি কারণ। অনেকেই ধুলাবালি, ফুলের রেণু, পশম কিংবা ঘরের পুরনো বই-জিনিসপত্র থেকে অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হন। এই অ্যালার্জি ঘুমের সময় গলায় প্রদাহ তৈরি করে।

ধূমপান, পানের গুঁড়া বা তামাকজাত দ্রব্য সেবনকারীদের ক্ষেত্রেও গলা খারাপ থাকা খুব সাধারণ বিষয়। এগুলো গলার শ্লেষ্মা স্তর নষ্ট করে ফেলে, ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠে গলা ব্যথা, খুসখুসে ভাব, এমনকি কফসহ কাশি দেখা যায়।

গলা খারাপ হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো হাইড্রেশনের অভাব। রাতে ঘুমের সময় আমরা অনেকটা সময় পানি না খেয়ে কাটাই। যদি সারাদিনও পানি কম পান করা হয়, তাহলে শরীরের পানি শূন্যতা গলায় প্রভাব ফেলে।

এছাড়া উচ্চস্বরে কথা বলা, অনেকক্ষণ গান গাওয়া বা উপস্থাপনা করার পর ঘুমালে গলার স্বর বসে যেতে পারে, কারণ কণ্ঠনালী অতিরিক্ত চাপে থাকে।

তবে এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার আছে, এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করলে সকালবেলা গলা খারাপ হওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে।

প্রথমত, রাতের বেলায় ঘুমানোর আগে এক গ্লাস হালকা গরম পানি পান করা ভালো। এতে গলার শুষ্কতা কিছুটা কমে এবং শ্বাসনালী আর্দ্র থাকে।

নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করলে শরীর ও গলার শ্লেষ্মা স্তর হাইড্রেটেড থাকে।

যারা সাইলেন্ট রিফ্লাক্সে ভোগেন, তাদের উচিত শোবার আগে অন্তত ২ ঘণ্টা কিছু না খাওয়া, মাথার দিক একটু উঁচু করে শোয়া, এবং ঝাল, তেল, কফি ও চকলেট এড়িয়ে চলা।

নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতে না পারলে সেটি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিরাময় করতে হবে। নাক খোলার স্প্রে বা বাষ্প নেওয়া যেতে পারে, তবে দীর্ঘদিন কোনো ওষুধ বা স্প্রে ব্যবহার না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।

ঘরের শুষ্কতা কমাতে চাইলে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে, অথবা ঘরে এক বালতি পানি রেখে ঘুমালে বাতাসের আর্দ্রতা কিছুটা বাড়ে।

যদি অ্যালার্জির সমস্যা থাকে, তবে বালিশের কাভার নিয়মিত ধোয়া, ধুলাবালি পরিষ্কার রাখা, এবং বিছানার চারপাশে কোনো পশমজাত জিনিস না রাখা ভালো।

ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য ত্যাগ করা উচিত, কারণ তা দীর্ঘমেয়াদে গলার মারাত্মক ক্ষতি করে।

সকালে উঠে হালকা গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গার্গল করলে গলার ব্যথা ও খুশখুশে ভাব কমে। এছাড়া আদা, মধু, লেবু দিয়ে তৈরি গরম পানিও গলার জন্য উপকারী।

যদি নিয়মিত গলা খারাপ থাকে, স্বর বসে যায় বা কফ জমে থাকে, তবে অবশ্যই একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ গলার কিছু সমস্যা যেমন টনসিল, পলিপ, সিস্ট বা টিউমারও গলা খারাপের কারণ হতে পারে, যেগুলো সময়মতো ধরা না পড়লে জটিলতা বাড়ে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সকালে ঘুম ভাঙার পর গলা খারাপ হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ থাকতে পারে, তবে সচেতনতা ও কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তুললে এই সমস্যার প্রতিকার সম্ভব। নিয়মিত পানি পান, সঠিক ঘুমের অভ্যাস, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই পারে আমাদের প্রতিদিন সকালে একটা সতেজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় অনুভূতি এনে দিতে।

এম.কে.

×