ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২

জাপানের এক রেস্তোরাঁ, যেখানে ভুল করা মানেই যোগ্যতা

প্রকাশিত: ২১:৫০, ১৫ জুলাই ২০২৫

জাপানের এক রেস্তোরাঁ, যেখানে ভুল করা মানেই যোগ্যতা

ছবি: সংগৃহীত

টেবিলে বসে আপনি অর্ডার করলেন ডাম্পলিং, কিন্তু পেলেন মিসো স্যুপ। আপনি চাইলেন গ্রিলড ফিশ, এল সুশি। পানি চেয়ে বসলেন, দেখা গেল ওয়েটার নিজেই সেই পানি খেয়ে ফেলেছে। কী ভাবছেন? এটা কোনো সার্ভিস দুর্বলতার নমুনা? মোটেও না। বরং এই ‘ভুল’টাই এখানে মূল আকর্ষণ। জাপানের 'রেস্টুরেন্ট অফ মিসটেইকেন অর্ডারস'—একটি পপ-আপ রেস্তোরাঁ, যেখানে খাবার ভুল এলে, ক্রেতারা রেগে যান না, বরং খুশি হন!

মানবিক ভুলই এখানে ব্র্যান্ড ভ্যালু

এই ব্যতিক্রমী রেস্তোরাঁর ওয়েটার-ওয়েট্রেসরা সবাই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। তাদের ভুল-ভ্রান্তিই এখানে উদযাপিত হয় এক ধরণের উষ্ণতা, সহানুভূতি ও হাসির আবহে। শিরো ওগুনি নামের একজন জাপানি টিভি পরিচালক এই রেস্তোরাঁর ধারণাটি দেন। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো এটি চালু হয়, এবং এরপর থেকে এটি একাধিকবার আয়োজন করা হয়েছে।

ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ বলতে এমন এক মানসিক অবস্থাকে বোঝায়, যার ফলে ব্যক্তি তার স্মৃতি, শেখার ক্ষমতা ও যোগাযোগের দক্ষতা হারাতে থাকেন। এই অসুস্থতা অনেক ধরনের হতে পারে, যার একটি হলো আলঝেইমার। ওগুনি প্রথম এই ধারণা পান এক নার্সিং হোমে গিয়ে, যেখানে তার অর্ডার করা বার্গারের বদলে ডাম্পলিং দেওয়া হয়েছিল। তখন তার মনে হয়, আসলে এটিই এক নতুন বাস্তবতা, যেখানে ভুলগুলোকেই সৌন্দর্য হিসেবে দেখা যেতে পারে।

ভুল অর্ডার, ঠিক সম্পর্ক

প্রথম আয়োজনেই দেখা গেছে, প্রায় ৩৭ শতাংশ অর্ডার ভুল ছিল, কিন্তু ৯৯ শতাংশ অতিথিই জানিয়েছেন, তারা তাতে খুশি ছিলেন। কারও মুখে বিরক্তির রেখা নেই। বরং কোনো ওয়েট্রেস ভুল করে বসে পড়েছেন অতিথির পাশে, কেউ আবার অতিথিকে অনুরোধ করছেন আশেপাশের অর্ডার নেওয়ার জন্য—এসবই যেন মঞ্চস্থ কৌতুক নাট্যের দৃশ্য।

এই রেস্তোরাঁ আসলে শুধুই খাবারের জায়গা নয়—এটা এক ধরণের সহানুভূতির চর্চা, যেখানে মানুষ ভুল গ্রহণ করতে শেখে, ভিন্নতা বুঝতে শেখে, সম্পর্ক গড়ে তোলে। এখানে গ্রাহকরা এসে শুধু খাবার খান না, বরং যারা সার্ভ করে, তাদের জন্য ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মানবিক যোগাযোগের হাত বাড়ান।

এক অর্থে, এখানে কর্মীরা যতটা না গ্রাহকের সেবা দেন, তার চেয়ে বেশি গ্রাহকরা সেবা দেন কর্মীদের—মানবিকতার মাধ্যমে। এই রেস্তোরাঁ যেন এক নতুন ব্যবসায়িক মডেল—যেখানে আয় আসে মানবিক সম্পর্ক থেকে।

ব্যবসার নতুন সংজ্ঞা: সম্পর্কই পুঁজি

লেখক এবং প্রযুক্তিবিদরা গত কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন, পণ্য ও সেবার জগতে প্রতিযোগিতা এত বেড়ে গেছে যে, এখন একটি ব্র্যান্ডের টিকে থাকার জন্য দরকার গভীর গ্রাহকসম্পর্ক। দাম বা গুণমান নয়, বরং গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কই ব্যবসার ভবিষ্যৎ।

'রেস্টুরেন্ট অফ মিসটেইকেন অর্ডারস' সেই কথাকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার নেই, অথচ গ্রাহকরা বারবার ফিরে আসছেন শুধু হাসিমুখে কেউ ভুল করে খাবার পরিবেশন করবে বলে।

এই রেস্তোরাঁ তাই শুধু ডিমেনশিয়ার মানুষদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়নি, সমাজকেও দেখিয়ে দিয়েছে—দয়া, সহানুভূতি আর ভিন্নতাকে আলিঙ্গন করেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

বৈশ্বিক পরিসরে প্রভাব

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১১.৫ কোটিতে। জাপানের মতো বয়স্ক-ভিত্তিক সমাজে এমন প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে এ ধরনের রেস্তোরাঁ চালু করে দেখিয়ে দিয়েছে, বিষয়টি বিশ্বজনীন।

ওগুনি বলেন, “আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে ডিমেনশিয়া থাকুক বা না থাকুক—সবাই একসাথে, সহানুভূতির সাথে থাকতে পারে।”

এই বক্তব্য কেবল সামাজিক দায় নয়, বরং ভবিষ্যতের ব্যবসার এক নতুন দিগন্তেরও দরজা খুলে দেয়।

ভুল খাবার পাওয়া নিয়ে সাধারণত আমরা বিরক্ত হই। কিন্তু যখন সেই ভুলের পেছনে থাকে এক মানবিক গল্প, হাস্যোজ্জ্বল মুখ, এবং সম্পর্ক গড়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা—তখন সেই ভুলই হয়ে ওঠে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। 'ভুল অর্ডারের রেস্তোরাঁ' আমাদের শেখায়, ভুল শুধুই ভুল নয়, তা হতে পারে বন্ধুত্বের শুরু।

Mily

×