ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

‘নীরব ঘাতক’ ফ্যাটি লিভার: যেভাবে বাড়ায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি!

প্রকাশিত: ২১:১৭, ৪ জুলাই ২০২৫

‘নীরব ঘাতক’ ফ্যাটি লিভার: যেভাবে বাড়ায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি!

ছবি: সংগৃহীত

ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। আবার অনেকে ফ্যাটি লিভার নামের রোগটির কথাও শুনেছেন। কিন্তু এই দুটি রোগ যে পরস্পর গভীরভাবে জড়িত এবং একে অপরকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দেয়—তা অনেকেই জানেন না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং ফ্যাটি লিভার রোগ একে অপরকে জ্বালানি যোগায়। শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ার মধ্য দিয়ে এই দুই রোগ একত্রে আরও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অথচ লক্ষ লক্ষ মানুষ এই দুটি সমস্যা একসঙ্গে বহন করছেন, তা না জেনেই।

ফ্যাটি লিভার কী?

ফ্যাটি লিভার বা চিকিৎসা পরিভাষায় নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) হলো যকৃতে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া। এটি শুধু মাত্র অ্যালকোহল সেবনের কারণে হয় না; অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত কার্বোহাইড্রেট এবং অলস জীবনযাপনও এর জন্য দায়ী।

যকৃত আমাদের শরীরে খাবার প্রক্রিয়াজাত করে, বিষাক্ত উপাদান ছেঁকে ফেলে এবং শক্তি সংরক্ষণ করে। কিন্তু অতিরিক্ত ক্যালোরি ও চিনির কারণে যখন যকৃতের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, তখন তা চর্বি জমিয়ে রাখে। এক পর্যায়ে এই চর্বি প্রদাহ, ক্ষত (ফাইব্রোসিস) এবং এমনকি সিরোসিসের মতো মারাত্মক অবস্থাও সৃষ্টি করতে পারে। ফ্যাটি লিভারের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না, তাই একে 'নীরব লিভার রোগ' বলা হয়।

ডায়াবেটিসের সঙ্গে সংযোগ কীভাবে?

টাইপ-২ ডায়াবেটিসে শরীর যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা ইনসুলিন কাজ করতে ব্যর্থ হয়। ফলাফল—রক্তে চিনি জমে যায়, যা ক্লান্তি, ঘন ঘন প্রস্রাব, ওজন বৃদ্ধি এবং হৃদয়, কিডনি ও লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ঘটায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এই দুই রোগের মূল সেতুবন্ধন। অর্থাৎ, যখন যকৃতে অতিরিক্ত চর্বি জমে, তখন এটি ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা হারায়, ফলে ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করে না। এতে অগ্ন্যাশয় আরও বেশি ইনসুলিন তৈরি করতে থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের দিকে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে, ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে অতিরিক্ত চিনি জমে, যেটা যকৃতে আরও চর্বিতে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়া আরও বেশি ফ্যাটি লিভার তৈরি করে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ায়—এইভাবে তৈরি হয় একটি ‘বিষাক্ত চক্র’, যা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।

নতুন গবেষণার তথ্য কী বলছে?

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ফ্যাটি লিভার রয়েছে, যদিও অনেকেই তা জানেন না। এমনকি যাদের অতিরিক্ত ওজন নেই, তাদের মধ্যেও এই ঝুঁকি রয়েছে।

বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই দুই রোগকে আর আলাদা করে দেখছেন না, বরং ‘মেটাবলিক ডিসফাংশন অ্যাসোসিয়েটেড স্টিয়াটোটিক লিভার ডিজিজ’ (MASLD) নামে একটি নতুন টার্ম ব্যবহার করছেন, যা NAFLD-এর আধুনিক রূপ।

সমাধান কি সম্ভব?

হ্যাঁ, সমাধান সম্ভব—তবে একসঙ্গে এই দুই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হবে। কারণ যেহেতু দুটি রোগ একে অপরকে বাড়িয়ে তোলে, তাই একটির চিকিৎসা করলে অপরটিও উপকৃত হয়। যেমন:

  • মাত্র ৫–১০% ওজন কমালেই যকৃতের চর্বি অনেকটা কমে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স উন্নত হয়।
  • চিনি ও পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট পরিহার করলে রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং লিভার সুস্থ থাকে।
  • সময়ানুযায়ী খাদ্য গ্রহণ (ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং) উপকারী হতে পারে।
  • নিয়মিত হাঁটা ও শরীরচর্চা ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং যকৃতে চর্বি জমা কমায়।
  • ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

চিকিৎসা না নিলে কী হতে পারে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) বলছে, ‘NAFLD ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস একে অপরকে বাড়িয়ে তোলে। লিভারে চর্বি জমে গেলে তা রক্তে চিনির মাত্রাও বাড়িয়ে দিতে পারে। আর দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচিনির প্রভাবে লিভারসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি হয়।’

দুঃখজনক হলেও সত্য, ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রুটিন চেকআপে অনেক সময় লিভার পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ফলে অনেকেই জানেন না, তারা একই সঙ্গে ফ্যাটি লিভারেও ভুগছেন।

আজকের দিনে ডায়াবেটিসকে আর একা একটি রোগ হিসেবে দেখলে চলবে না। এটি একটি বিস্তৃত বিপাকীয় সমস্যার অংশ, যেখানে লিভার, অগ্ন্যাশয়, অন্ত্র ও চর্বি কোষ একে অপরের সঙ্গে জড়িত।

 

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া।

রাকিব

×