ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

‘নীরব ঘাতক’ তাপপ্রবাহে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে বিশ্ব! গ্রীষ্মের ভয়াল আগ্রাসন নিয়ে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ৪ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২৩:৫১, ৪ জুলাই ২০২৫

‘নীরব ঘাতক’ তাপপ্রবাহে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে বিশ্ব! গ্রীষ্মের ভয়াল আগ্রাসন নিয়ে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা

ছবিঃ সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ গরমে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন—এই নীরব ঘাতক তাপপ্রবাহ মানব সভ্যতার জন্য এক ক্রমবর্ধমান প্রাণঘাতী সংকটে রূপ নিচ্ছে। শুধুমাত্র জুন মাসেই স্পেন ও যুক্তরাজ্যে তাপজনিত কারণে প্রায় ৯৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিক হিসাব জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

দক্ষিণ ইউরোপে তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। স্পেনের কাতালোনিয়া অঞ্চলে দাবানলে ২ জন নিহত ও ২০,০০০ মানুষ লকডাউনে গেছে। দাবানলটির গতি ছিল ঘণ্টায় ২৮ কিলোমিটার, যা ইউরোপে রেকর্ড গতির দাবানলগুলোর একটি।

যুক্তরাজ্য ও স্পেন—উভয় দেশই তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ জুন মাস পার করেছে। শুধুমাত্র ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ১৯–২২ জুনের মধ্যে প্রায় ৫৭০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাপপ্রবাহজনিত কারণে। স্পেনেও তাপের প্রভাবে মারা গেছে প্রায় ৩৮০ জন।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলেও রেকর্ড গরমে বিদ্যুৎ ঘাটতির হুমকি দেখা দেয়ায় জরুরি অবস্থা জারি করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

জাপানেও ১৮৯৮ সাল থেকে রেকর্ড সংরক্ষণের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে গরম জুন মাস হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির আবহাওয়া সংস্থা।

‘নীরব ঘাতক’ কেন তাপপ্রবাহ

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্রানথাম ইন্সটিটিউটের পরিবেশবিষয়ক গবেষক গ্যারি ফলস কনস্টান্টিনোডিস বলেন, “তাপপ্রবাহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো দৃশ্যমান না হলেও সবচেয়ে প্রাণঘাতী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ হিসেবে তাপকে উল্লেখ করা হয় না, যার ফলে প্রকৃত সংখ্যা উপেক্ষিত থেকে যায়।”

কেন ইউরোপে এত তীব্র গরম?

পিটার ডাইনস, পরিবেশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান MEER-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বলেন, ইউরোপে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রার তুলনায় দ্বিগুণ হারে উষ্ণতা বাড়ছে। এর পেছনে কারণ আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায় সূর্যের তাপ প্রতিফলনের হার কমে যাওয়া এবং ভূমির দ্রুত উত্তপ্ত হওয়া।

তাছাড়া ইউরোপজুড়ে নদী-জলাশয়ের শুকিয়ে যাওয়া, ভূখণ্ডভিত্তিক জলবায়ু এবং ক্লিন এনার্জি নীতির আওতায় শিল্প দূষণ কমে যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলে কম বায়বীয় কণা থাকছে—এসবই সূর্যরশ্মি বেশি পৌঁছাতে সহায়তা করছে।

কারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে?

কিংস কলেজ লন্ডনের জোশ ফস্টার বলেন, গরমের প্রভাবে শুধু বয়স্ক ব্যক্তিরাই নন, যে কেউই ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। গত মাসে স্পেনে একটি গাড়িতে আটকে থাকা ২ বছরের শিশু ও এক সাফাই কর্মী গরমে মারা যান।

২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে একটি মাত্র তাপপ্রবাহেই ৭০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৫,০০০ অতিরিক্ত মৃত্যু রেকর্ড করা হয়। তাপজনিত মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে দেখা গেছে হৃৎপিণ্ড, কিডনি, এবং সংক্রমণজনিত জটিলতা।

গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও তাপমাত্রার প্রভাবে সন্তানের জন্মগত ত্রুটি, স্থূলতা ও মৃতভ্রূণের ঝুঁকি বাড়ে।

তিনি সতর্ক করে বলেন, “৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রায় ফ্যান কাজ করে না, বরং ৪০ ডিগ্রির বেশি হলে তা ক্ষতিকরও হতে পারে।” এই পরিস্থিতিতে ত্বকে পানি ছিটিয়ে ঘাম তৈরি করা এবং পর্যাপ্ত পানি পান করাই উত্তম প্রতিকার।

এই গ্রীষ্মে ইউরোপে কত মৃত্যু হতে পারে?

২০২২ সালে মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬১,৬৭২ জন মারা যান তাপজনিত কারণে, যার ৫৬% দায়ী ছিল মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য—এমনটাই জানায় বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথ।

চলতি বছরের সূচনার আগেই হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর হার বাড়ায় গবেষকরা বলছেন, ২০২২ সালের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞ কনস্টান্টিনোডিস বলছেন, বায়ুমণ্ডলীয় গতিপ্রকৃতি ও পরিস্থিতি ২০২২ সালের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপে দীর্ঘস্থায়ী গরম এবং উত্তরের দিকেও দাবদাহের আশঙ্কা রয়েছে।

জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা

জোশ ফস্টার বলেন, “জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই এ ধরনের ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করে আসছিলেন। কিন্তু এখন এসব ঝুঁকি ভবিষ্যতের পূর্বাভাস নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতা।”

তিনি আরও বলেন, গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি বেড়ে গেলে পৃথিবীর প্রায় ৩০% এলাকা বয়স্কদের জন্য বাসযোগ্য থাকবে না।

রয়্যাল নেদারল্যান্ডস মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ভিকি থম্পসন বলেন, “মানবসৃষ্ট কার্বন নিঃসরণের কারণে পৃথিবী জুড়ে তাপপ্রবাহের তীব্রতা, সংখ্যা ও সময়কাল ভয়াবহ হারে বাড়ছে।”

তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই যে গরম আমরা এখন দেখছি, এটিই স্বাভাবিক নয়, বরং সামনের ভয়ঙ্কর দিনের এক নমুনা মাত্র। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।”

সূত্রঃ আনাদলু

ইমরান

×