ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

পুকুর থেকে ইংলিশ চ্যানেল জয়: পাবনার সাগরের সাহসিকতার গল্প  ‎ ‎

রাকিবুল হাসান, পাবনা ‎

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ১ আগস্ট ২০২৫

পুকুর থেকে ইংলিশ চ্যানেল জয়: পাবনার সাগরের সাহসিকতার গল্প  ‎ ‎

ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ

দুঃসাহস আর সংকল্প যখন একসাথে মিলে যায়, তখন গড়ে ওঠে ইতিহাস। ঠিক তেমনই এক ইতিহাস গড়লেন পাবনার মাহফিজুর রহমান সাগর। ইংলিশ চ্যানেলের হিমশীতল জলরাশি পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন অনন্য এক কৃতিত্বের শিখরে। তার সাথে ছিলেন কিশোরগঞ্জের নাজমুল হক হিমেল। মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই টানা ১২ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতরে এই দুই সাঁতারু সফলভাবে অতিক্রম করেন ইংলিশ চ্যানেল।

‎পাবনা শহর থেকে দূরে, দ্বীপচরের লাউদাড়া গ্রামের ছোট্ট এক পুকুর। সেখানেই শুরু হয়েছিল স্বপ্নের সাঁতার। আর আজ সেই স্বপ্ন পৌঁছে গেছে বিশ্বের অন্যতম কঠিন জলপথ—ইংলিশ চ্যানেলের উত্তাল ঢেউয়ে। মাহফিজুর রহমান সাগর নামটির সঙ্গে এখন আর শুধু ‘পাবনার সাঁতারু’ শব্দটি জুড়ে থাকে না—এখন তিনি সেই তরুণ, যিনি বুক চিতিয়ে পাড়ি দিয়েছেন ইংলিশ চ্যানেল। বাংলাদেশের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন সাহসিকতার নতুন অধ্যায়ে।



‎বাবা মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান টিংকু। মাতা নিলুফা বেগম।দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সাগর সবার ছোট। তার বাড়ীর সামনের পুকুর থেকে বাবার অনুপ্রেরণায় সাঁতারের শুরু।

‎ছোটবেলায় সাগরের খেলার মাঠ ছিলো বাড়ির সামনের পুকুর। বাবার কড়া স্নেহময় কণ্ঠে ভেসে আসত, "সাঁতার শেখো, শক্ত হও।" সেই বাবা—আজিজুর রহমান টিংকু—ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য লড়েছেন অস্ত্র হাতে। আর ছেলে সাগর লড়াই করলেন ঢেউয়ের বিপরীতে, শরীর আর মানসিক জোরে।

‎পাবনার রফিকুল ইসলাম সুইমিং পুল ছিল সাগরের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সাঁতারের মঞ্চ। সেখান থেকে বিকেএসপিতে ভর্তি, জাতীয় পর্যায়ে পাঁচবার সেরা সাঁতারু, অসংখ্য পদক। প্রতিটি ধাপে সাগরের ভেতর গড়ে উঠেছে এক নির্মোহ, দৃঢ়চেতা যোদ্ধা।



‎জুলাইয়ের শুরুতে সাগর ও তার সঙ্গী কিশোরগঞ্জের নাজমুল হক হিমেল রওনা দেন লন্ডনের পথে। উদ্দেশ্য একটাই—ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া। তবে বিষয়টি এমন নয় যে গিয়ে সাঁতার দিলেই হল। অপেক্ষা করতে হয় আবহাওয়ার অনুকূলতার জন্য, জানতে হয় স্রোতের ধরন, জেলিফিশের উপস্থিতি, পানির তাপমাত্রা।

‎২৯ জুলাই, সকাল। একটানা ১২ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতরেছেন সাগর। পানির তাপমাত্রা ছিল ১৫ থেকে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীর শীতল হয়ে আসে, পেশি বেঁকে যায়, মন চায় থেমে যেতে। কিন্তু সাগরের ভেতরে গড়িয়ে চলেছে অন্যরকম স্রোত—সেটা আত্মবিশ্বাসের, দেশের প্রতি ভালোবাসার, আর বাবার বলা সেই পুরোনো কথাগুলোর।

‎যখন চ্যানেলের বিপরীত পাড়ে পা রাখেন, তখন সাগরের চোখে পানি। হয়ত ঠান্ডার কারণে, হয়ত আনন্দে। কিন্তু পাবনায় তার মা নিলুফা বেগমের চোখে পানি ছিল একটাই অর্থে—গর্ব। স্থানীয় লোকজন, প্রতিবেশী, জেলা প্রশাসক, কোচ—সবাই যেন গর্বে ভরে উঠেছেন সাগরের এই বিজয়ে। লাউদাড়ার পুকুরটা হয়ত সেদিন আরও উচ্ছ্বাসে ঢেউ তুলেছে।
‎ 
‎তবে সাগরের গল্পটা শুধু সাঁতারের নয়। এটা এক পিতা থেকে ছেলের কাছে উত্তরাধিকার হয়ে আসা সাহসের গল্প। এটা গ্রামের পুকুর থেকে সমুদ্র জয়ের গল্প। এটা প্রমাণ, স্বপ্ন বড় হলে—জল, শীত, জেলিফিশ—কিছুই থামাতে পারে না একজন সত্যিকারের যোদ্ধাকে।



‎মাহফিজুর রহমান সাগরের এই সাফল্য যেন আরেকবার মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও বিশ্বজয় সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রতিভা লালন, আর একফোঁটা সাহস।

‎ইংলিশ চ্যানেলের হিমশীতল জলরাশি ভেদ করে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা যেদিন বাতাসে ওড়ে—সেদিনই বুঝি জন্ম হয় এক সত্যিকারের বিজয়ের গল্প। ছোটবেলার সেই গ্রামের পুকুর থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা—আর আজ মাহফিজুর রহমান সাগর পাড়ি দিয়েছেন বিশাল ইংলিশ চ্যানেল। জলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে শুধু সাঁতরেই নয়, তিনি পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্ন, সংগ্রাম আর সাফল্যের পথও। 

‎ছেলেটির মা নিলুফা বেগম বলেন, আজকে যদি তার বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে অনেক খুশি হতেন। এটা জয়ের স্বার্থকতা ফুটে উঠত। বছর দুই হলেন সে মারা গিয়েছে। আজকে ছেলের এতোবড় সাফল্যে বুক ভরে যাচ্ছে। আপনারা সবাই ছেলেটির জন্য দোয়া করবেন। ছেলে যেন মানুষের মত মানুষ হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।

‎আমার ছেলে ছোট বেলা থেকে খুবই মেধাবী ছিল। ওর বাবার অনুপ্রেরণায় আজকে সে সাঁতার শিখছে। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য। আমার ছেলেও যেন মানুষের জন্য কাজ করতে পারে। 

‎পাবনার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন,  আমরা খুবই গর্ববোধ করছি ছেলেটি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ায়। সে আগামীতে আরও বড় কিছু হোক এই শুভ কামনা থাকল।

‎এর আগে, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন বাংলাদেশের তিনজন সাঁতারু। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী প্রথম এশীয় সাঁতারু ব্রজেন দাস। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে মোট ছয়বার চ্যানেলটি অতিক্রম করেন তিনি। 

 

নোভা

×