ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

ডলার কীভাবে বিশ্ব শাসন করে?

প্রকাশিত: ১৬:৩৩, ১ আগস্ট ২০২৫

ডলার কীভাবে বিশ্ব শাসন করে?

ছবিঃ সংগৃহীত

আপনি যদি ঘরে বসে টাকা ছাপাতে শুরু করেন, সেটি হবে জাল টাকা। ধরা পড়লে শাস্তি নিশ্চিত। কিন্তু কল্পনা করুন, যদি সবাইকে টাকা ছাপানোর অধিকার দেওয়া হতো—তাহলে কি হতো? সবার হাতে কোটি কোটি টাকা থাকত, কিন্তু সেই টাকার আর কোনো মূল্য থাকত না। কারণ, টাকার মূল্য নির্ভর করে তার বিরলতা এবং মানুষের বিশ্বাসের উপর।

বিশ্বের প্রতিটি দেশের মতো বাংলাদেশেও কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নতুন টাকা ছাপতে পারে। এই প্রক্রিয়াটিকে সাধারণত সুশৃঙ্খল ও সরকারি নীতিনির্ধারণ অনুযায়ী বলে মনে হলেও, এর পেছনে আছে গভীর ও জটিল একটি ব্যবস্থাপনা—ফিয়াট অর্থনীতি।

কাগজে নয়, কম্পিউটারে তৈরি হয় টাকা
আপনি যখন ব্যাংক থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নেন, তখন ভাবতে পারেন এই টাকা নিশ্চয়ই কারও সঞ্চয় থেকে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংক সেই অর্থ সৃষ্টি করে কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটি সংখ্যা বসিয়ে। ব্যাংকের হাতে যদি ১০ টাকা থাকে, তবে সে তার দশগুণ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং।

ব্যাংকগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে নতুন টাকা তৈরি করে, যা বাজারে মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে। ভুল নীতিমালা, দুর্নীতি বা অতিলোভে কিছু ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তার বোঝা পরে সাধারণ মানুষের ঘাড়েই—হোক তা কর হিসেবে, কিংবা বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক দামে।

কাগজের নোটের পেছনের ইতিহাস
প্রাচীন যুগে মানুষ পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে লেনদেন করত, যাকে বাটার সিস্টেম বলা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে অসুবিধা ছিল—যদি দুজনের প্রয়োজন একে অপরের পণ্যে না থাকে, তাহলে লেনদেন সম্ভব নয়। তাই মানুষ ধীরে ধীরে সোনা, রুপা, লবণ, এমনকি ঝিনুক ব্যবহার শুরু করে।

সমস্যা হলো—যে জিনিস সহজলভ্য, তার মূল্য পড়ে যায়। তাই সবাই দৃষ্টি দেয় দুষ্প্রাপ্য ধাতুর দিকে—বিশেষ করে সোনা ও রুপার দিকে। তবে সেগুলোও বহন ও যাচাই করার ঝামেলা থাকায় পরে আসে ধাতব মুদ্রা। এরপর রাজারা বুঝলেন ধাতুর সঙ্গে সরাসরি না গিয়েও যদি কাগজে সিল দিয়ে প্রমাণপত্র দেওয়া যায়, সেটিও মানুষ গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে সেই কাগজই হয়ে উঠল বিনিময়ের মাধ্যম।

ফিয়াট কারেন্সি: অর্থ মানে শুধু বিশ্বাস
ফিয়াট (Fiat) শব্দের অর্থ 'এটি সম্পন্ন হোক'—অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রীয় আদেশে কোনো কিছুর মূল্য নির্ধারণ। আজকের কাগজের টাকা নিজে সোনার মত কোনো ভৌত সম্পদের সঙ্গে যুক্ত না হলেও, সরকারের আদেশ আর জনগণের বিশ্বাসেই তার মূল্য।

এক সময় প্রতিটি ডলারের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ সংরক্ষিত থাকত। কিন্তু যুদ্ধ ও খরচ বৃদ্ধির কারণে ১৯৭১ সালে আমেরিকা সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঘোষণা করেন, আর ডলারের বিপরীতে সোনা দেওয়া হবে না। তখন থেকেই পুরো অর্থনীতি হয়ে পড়ে ঋণনির্ভর।

বিশ্বব্যাপী আমেরিকার ডলারের আধিপত্য
ডলার হয়ে উঠেছে বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চুক্তি করে পেট্রোডলার চালু করে, যেখানে তেল কেনাবেচা হবে শুধু ডলারে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ সবকিছুই পশ্চিমা প্রভাবাধীন হওয়ায় দেশের জন্য ডলার ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ফলে আমেরিকা চাইলে নিজেদের প্রয়োজনেই যত খুশি টাকা ছাপাতে পারে, অথচ অন্য দেশের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

এই ব্যবস্থার কারণে যেমন ধনী দেশগুলো আরো ধনী হচ্ছে, তেমনি দরিদ্র দেশগুলো ঋণের বোঝা টানছে। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার জাতীয় ঋণ ছিল জিডিপির ১১৯%—যা আমেরিকার থেকেও কম, তবু দেউলিয়া হয়ে পড়ে দেশটি।

বিকল্প ভাবনা: কিন্তু পথ কি খোলা?
ব্রিক্স দেশগুলো (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) বিকল্প ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ সোনার সঙ্গে মুদ্রা যুক্ত করার চিন্তা করছে। আবার অনেকে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বিকল্প ভাবছে। কিন্তু সবকিছুতেই বাধা—রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং মার্কিন নিয়ন্ত্রণের ভীতি।

টাকা আসলে এক বিশ্বাসের খেলা
আমরা যে নোটটি হাতে নিই, সেটির কাগজের দাম হয়তো ২০ টাকার কম। কিন্তু সেটি দিয়ে আমরা চাল কিনি, ভাড়া দিই, সঞ্চয় করি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি সেটি মূল্যবান। অথচ এই অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ঋণ ও অসীম চাহিদার ওপর।

মুদ্রানীতিতে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা এবং জনকল্যাণের চিন্তা না থাকলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসতে পারে। তাই প্রয়োজন অর্থনৈতিক বাস্তবতা বুঝে চলা, সচেতন থাকা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকা।

 

মারিয়া

×