ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

জুলাই স্মৃতি জাদুঘর ঘিরে কর্মযজ্ঞ, ৫ আগস্ট উদ্বোধন

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ২ আগস্ট ২০২৫

জুলাই স্মৃতি জাদুঘর ঘিরে কর্মযজ্ঞ, ৫ আগস্ট উদ্বোধন

.

বাঙালির রয়েছে দীর্ঘকালের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। আর সেই সংগ্রামী ইতিহাসেরই এক অনন্য অধ্যায় ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার সংঘটিত সেই দুর্বার আন্দোলনের স্মৃতিকে সঙ্গী করে শেরেবাংলা নগরের গণভবনকে ঘিরে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি  নির্মাণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন শত শত শ্রমিক। আর এই কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছে অভ্যুত্থানের ইতিহাস ধারণ ও সংরক্ষণ করা। 
সেই পথরেখায় অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসগৃহ গণভবন পরিণত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে। ভবনসহ ১৫ একরের বিশাল আঙিনায় গড়ে উঠছে এই স্মৃতি জাদুঘর। আগামী ৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এই জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। তবে সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন হলেও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের নানা অধ্যায়কে ধারণ করবে ব্যতিক্রমী এই জাদুঘর। মেলে ধরবে বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দেওয়া শহীদের রক্তে ভেজা অভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা। লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস উপেক্ষা করে আন্দোলনকে পরিণতির পথে নিয়ে যাওয়া জুলাই যোদ্ধাদের সাহসিকতার ধারাভাষ্য দেবে এই জাদুঘর।  
এখানে ঠাঁই পাবে বুকের রক্তে ঢেলে দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটানো সকল জুলাই শহীদের নাম ও ছবি। থাকবে শহীদদের ব্যবহৃত নানা স্মৃতি স্মারক। তথ্যচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপিত হবে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার। জুলাইয়ের প্রথম শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে নির্মিত ভাস্কর্যসহ নানা কিছু থাকবে। জুলাইয়ে জ্বলে ওঠা নারীদের অংশগ্রহণকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হবে। সম্মুখ সারিতে থাকা জুলাই যোদ্ধাদের বয়ান উঠে আসবে তথ্যচিত্রে। একটি স্থাপনার মাধ্যমে আয়নাঘরের পুনর্চিত্রায়ন ঘটানো হবে। এই কক্ষে আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালার নির্যাতনের ভয়বহতাকে তুলে ধরা হবে। 
মানচিত্রের মাধ্যমে অভ্যুত্থানকালীন দেশের ৬৪ জেলার আন্দোলননির্ভর ঘটনাপ্রবাহ উঠে আসবে মনসুন আর্কাইভ নামের স্থাপনায়। ভিডিওচিত্রে উপস্থাপিত হবে গণঅভ্যুত্থানের পরিণতিস্বরূপ শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। এসব ঘটনার পাশাপাশি বিগত সরকারের শাসনামলে গুম, খুন, দুর্নীতি, নির্যাতনসহ দুঃশাসনের বিষয়গুলোও উপস্থাপন করা হবে। সব মিলিয়ে অভ্যুত্থানের সামগ্রিকতার সমান্তরালে বিগত সরকারের দেড় দশকে দুঃশাসনকে স্মরণ করিয়ে দেবে এই জাদুঘর।
জুলাই আন্দোলনের স্থিরচিত্র, চিত্রকর্ম, পোস্টার,  বিভিন্ন স্মারক, শহীদদের জামাকাপড়, চিঠি, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, ওই সময়ের পত্রিকার কাটিং, অডিও-ভিডিওসহ বিভিন্ন স্মৃতি স্মারক থাকবে  জুলাই স্মৃতি জাদুঘরে। মাল্টি ডিসিপ্লিনারি বা মিশ্র মাধ্যমের সংযোগে গড়ে উঠবে জাদুঘর। সে কারণেই জুলাই আন্দোলনে মানুষকে অনুপ্রাণিত করা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট উপস্থাপিত হবে ভিন্নধর্মী এই  আধুনিক জাদুঘরে। গুরুত্ব পাবে আন্দোলননির্ভর ডিজিটাল আর্ট, এনিমেশন  ও ইলাস্ট্রেশননির্ভর উপস্থাপনা।  
গণভবনের দোতলার ভবনটি অবিকৃত রেখেই নির্মিত হচ্ছে এই জাদুঘর। এটি হবে জাদুঘরের মূল ভবন। গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন হওয়ার পর সেখানে ঢুকে পড়ে আন্দোলনে রাজপথে নেমে আসা জনতা। দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়া মানুষ তছনছ করে দেয় লাল রঙের ভবনটি। ভেঙে ফেলা হয় আসবাবপত্র,  চেয়ার-টেবিল, লাইটসহ নানা কিছু। উল্টোদিকে ওই ভবনের দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকাসহ শেখ হাসিনার দুঃশাসন নিয়ে লেখা হয় নানা মন্তব্য। 
তাই জাদুঘরে প্রবেশের পর দুঃশাসনের  বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ যেন দর্শক উপলব্ধি করতে পারে সেই বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করে  অবিকৃত রাখা হচ্ছে ভবনকে। আর এই ভবনে প্রবেশের আগে সামনের ডানপাশের বিস্তৃত আঙিনায় নির্মাণ হচ্ছে মেমোরিয়াল বা  সমাধিসৌধ। এখানে শোভা পাবে চব্বিশের সকল জুলাই শহীদের নাম ও ছবি। এছাড়া বিগত শাসনামলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-সহ নির্যাতনের শিকার মানুষের নাম-পরিচয় তুলে ধরা হবে এই মেমোরিয়ালে।
জুলাই স্মৃতি জাদুঘর এটি হবে অংশীদারিত্বমূলক একটি ভিন্নধর্মী জাদুঘর। সেখানে থাকবে আন্দোলন নিয়ে সাধারণ মানুষের তোলা আলোকচিত্র। উপস্থাপন হবে আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জোগানো সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট। শহীদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন স্মারক পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে ঠাঁই পাবে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার। থাকবে অডিও ও ভিডিও মাধ্যমে ধারণকৃত বিগত শাসনামলে নিপীড়িত মানুষের বয়ান। 
ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে সাক্ষাৎকারভিত্তিক জুলাই যোদ্ধাদের গল্প। জুলাই শহীদদের পরিবারের ধারাভাষ্য বা সাক্ষাৎকার স্মরণ করিয়ে দেবে বিয়োগান্তক সেই অধ্যায়কে। অডিও ও ভিডিও মাধ্যমের আশ্রয়ে বিগত শাসনামলের দুঃশাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণসহ রাষ্ট্রীয় সংকটকে তুলে ধরা হবে। থাকবে  নিপীড়নের ঘটনাসমূহের বিভিন্ন আলামত ও তথ্য। সেখানে যুক্ত হবে গণভবনে পাওয়া নিপীড়নের সাক্ষ্যবহ বিভিন্ন নথিপত্র। চব্বিশের আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রিক্সাচালক মোহাম্মদ সুজনের স্যালুট জানানোর দৃশ্যটি ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরবেন ভাস্কর তেজশ হালদার। এছাড়া অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদকে নিয়েও গড়া ভাস্কর্যসহ নানা কিছু উপস্থাপন করা হবে। 
জাদুঘরের মূল ভবনের একটি কক্ষে গড়া হবে আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা। এই কক্ষে প্রবেশের পর দর্শনার্থীরা অনুভব করবেন বন্দিদের নির্যাতনের ব্যথা-বেদনা। পৃথক আরেকটি কক্ষে থাকবে জুলাই পাঠ কেন্দ্র। এখানে অভ্যুত্থানের ওপর রচিত বিভিন্ন বইপত্রসহ গবেষণাধর্মী নানা তথ্যের সমাহার ঘটবে। উপস্থাপন করা হবে ভয়কে জয় করে আন্দোলনে শামিল হওয়া নারীদের সাহসিকতার গল্প।    
জুলাই স্মৃতি জাদুঘরের সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা বিভাগের পরিচালক তানজীম ওয়াহাব। জাদুঘরের সার্বিক বিষয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এটি হবে অংশীদারিত্বমূলক এক জাদুঘর। ব্যতিক্রমী এই জাদুঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দর্শনার্থীর স্মৃতির আয়নায় ভেসে উঠবে জুলাই অভ্যুত্থান। অন্যদিকে বিগত সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনামলের সাক্ষ্যবহ বিভিন্ন উপস্থাপনা দর্শনার্থীদের চৈতন্যে কড়া নাড়বে। এই জাদুঘর অবলোকনের পর তারা সেই স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হবে এবং পুনরায় কখনো দুঃশাসনের কবলে ফিরে যেতে চাইবেন না। এক অর্থে এই জাদুঘর হবে পাবলিক ট্রায়াল বা জনতার আদালত। 
আগামী ৫ আগস্ট জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্ভাবনা থাকলেও বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে প্রধান উপদেষ্টাসহ বাকি সকল উপদেষ্টার আন্তরিক সহযোগিতা জাদুঘরের নির্মাণ কাজকে এগিয়ে নিচ্ছে। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘর খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে যত দ্রুত সম্ভব উন্মুক্ত করে দেওয়া। তবে ৫ আগস্ট গণভবনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার কারণে অনেক কিছু নষ্ট হয়েছে। চুরি হয়ে গেছে অনেক কিছু। স্বৈরশাসনের  বিরুদ্ধে আমজনতার প্রতিক্রিয়ার স্মৃতি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের অনেক কিছু অপরিবর্তিত রেখেই মেরামতের কাজ করা হচ্ছে। সে কারণে এখানে প্রচুর কাজ করতে হচ্ছে। সেগুলো সম্পন্ন করার পরই জাদুঘর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে এই জাদুঘরকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।       
এ বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন,  আগামী ৫ আগস্ট জুলাই স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। তবে জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে আরও পরে। স্মৃতি জাদুঘরের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, একজন দর্শনার্থী এখানে প্রবেশ করার পর উপলব্ধি করতে পারবেন কেন হলো জুলাই বিপ্লব। এছাড়া আওয়ামী লীগের দুঃশাসন এবং অভ্যুত্থানের স্মৃতিবহ নানা অনুষঙ্গ থাকবে জাদুঘরে। 
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের অপরাধের বিচার করবেন আদালত। আমাদের উদ্দেশ্য হলো একজন দর্শনার্থী জাদুঘরে এসে যেন শেখ হাসিনার অপরাধের বিচার নিজের বিবেক দিয়ে অনুধাবন করতে পারেন। ভবনটিকে এমনভাবে জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে যাতে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠে। গণভবনকে মূল আদলে রেখেই ফুটিয়ে তোলা হবে হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামল।

প্যানেল

×