
.
আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ের জন্যই কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা তৈরি হতে পারে। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের সক্ষমতা কমে যায়। যে কারণে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে। অন্যদিকে আমানতকারীদের জন্য তাদের জমার ওপর সুদের হার কমে যেতে পারে অথবা তাদের আমানত তোলার ওপর সীমাবদ্ধতা আসতে পারে।
সম্প্রতি উন্নতির দিকে যাওয়া ব্যাংক খাতের আমানত প্রবৃদ্ধি আবার কমতে শুরু করেছে। ব্যাংক খাত একীভূতকরণ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় অনেকেই আবার টাকা তুলে কাছে রাখছেন। এতে একদিকে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বেড়ে রেকর্ড তিন লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। আরেকদিকে ব্যাংক খাতের আমানত প্রবৃদ্ধি কমে ৭ শতাংশের নিচে নেমেছে। এর আগে গত ডিসেম্বরের পর থেকে যেখানে আমানত প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এখন আমানতের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমেছে। সুদহার বৃদ্ধির ফলে আমানত বাড়বে। আমানত না বাড়লে ঋণ বাড়ানো যাবে না। আমরা ব্যাংক থেকে ডলার কিনে টাকা দিচ্ছি। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ছে। এভাবে এক সময় সুদের হার এক অঙ্কে নেমে আসবে।’
ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্তের বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘যেসব ব্যাংককে টাকা দেওয়ার পরও নিজের পায়ে দাঁড়াতে
পারেনি তাদের একীভূত করা হবে। তবে আমানতকারীদের চিন্তার কিছু নেই। সবার টাকা নিরাপদ থাকবে। এসব ব্যাংক আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় দাঁড়াবে। আমরা আশাবাদী এজন্য সরকার যে টাকা বিনিয়োগ করবে তাও ফেরত আসবে। আপাতত ৫ ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে কাজ এগোচ্ছে।’
ব্যাংকারদের পরামর্শ এই পরিস্থিতিতে কোনো ব্যাংক একীভূতকরণ বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিলে দ্রুত করা উচিত। তা না হলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেবে।
ব্যাংকাররা জানান, গত ৫ আগস্ট সরকার পতন এবং কয়েকটি ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র সামনে আসার পর আতঙ্কের কারণে মানুষের টাকা তোলার চাপ ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তারল্য সহায়তা নিয়ে ব্যাংকগুলো গত সেপ্টেম্বর থেকে টাকা ফেরত দিতে শুরু করলে আবার আস্থা ফিরতে শুরু করে। এর মধ্যে গত মে মাসে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ, অবসায়ন বা অধিগ্রহণের জন্য ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ জারি হয়। তবে এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা না পাওয়ায় আমানতকারীদের মধ্যে আবার টাকা তোলার প্রবণতা বেড়েছে। একীভূতকরণের আলোচনায় থাকা এক্সিম, সোস্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী এবং ইউনিয়ন ছাড়াও অন্য ব্যাংক থেকেও টাকা তোলার চাপ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর ঈদের আগে কেনাকাটাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের কাছে নগদ টাকা রাখার প্রবণতা বাড়ে। বিশেষ করে কোরবানি ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি নগদ টাকা থাকে মানুষের হাতে। গত কোরবানি ঈদের আগে সর্বশেষ ব্যাংকিং কর্মদিবস গত ৫ জুন রেকর্ড তিন লাখ ৩৯ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা প্রচলনে ছিল। গত মে শেষে যা ছিল তিন লাখ ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। আর গত বছরের কোরবানির ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস ১৩ জুন প্রচলনে ছিল তিন লাখ ২৫ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত মে শেষে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ১৮ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। আর ঋণ ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়ে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর এডিআর নির্ধারিত সীমার অনেক বেশি হয়েছে। এর আগে গত ডিসেম্বরে আমানত প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমেছিল। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে গত মার্চে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশে ওঠে। সেখান থেকে ফের কমছে।
গত মার্চ পর্যন্ত আমানত কমার তালিকায় ছিল ১১টি ব্যাংক। চলতি বছরের মে শেষে এ তালিকায় রয়েছে ১৬টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানার বেসিক, বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী, এক্সিম, আইসিবি ইসলামিক, ন্যাশনাল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স, মধুমতি, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি ব্যাংক। বিদেশি মালিকানার ব্যাংক আলফালাহ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, উরি, হাবিব ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। বিদেশি ব্যাংকগুলো আমানত বা ঋণ নেওয়ার চেয়ে এলসিসহ বিভিন্ন কমিশন ব্যবসায় বেশি জোর দেয়। এসব ব্যাংক সুদহার অনেক কম দিয়ে আমানত নিরুৎসাহিত করে। ফলে দেশীয় ব্যাংকের আমানত কমা এবং বিদেশি ব্যাংকের কমার কারণ এক না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অতীতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি, একক গ্রুপের বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ এবং খেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি- সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত আজ চরম আস্থাহীনতায় পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ঋণ দিয়েছে। একীভূতকরণের জন্য নির্ধারিত পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা তাদের মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ।
প্যানেল