
ইতিহাসের পটভূমিতে ইসলামি স্বর্ণযুগ এক অনন্য ও দীপ্তিমান অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এই স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছে জ্ঞান, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন এবং প্রশাসনিক উৎকর্ষতার এক মহান অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই উত্থানের কেন্দ্রস্থল ছিল এক অনবদ্য শহর; বাগদাদ। আর এই শহরের স্থপতি ছিলেন আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর (খিলাফতকাল: ৭৫৪–৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ)। তার দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংস্কৃতিক দূরদর্শিতাই ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্রকে কুফা বা দামেস্ক থেকে স্থানান্তর করে নিয়ে আসে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মাঝামাঝি এক কৌশলগত স্থানে; যেখানে গড়ে ওঠে বাগদাদ।
আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম দিকেই আল-মনসুর উপলব্ধি করেন যে, একটি সুপরিকল্পিত ও প্রশাসনিকভাবে সংগঠিত রাজধানী না থাকলে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের কার্যকরী পরিচালনা সম্ভব নয়। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাগদাদ নগরী নির্মাণের কাজ শুরু করেন। শহরটি ছিল গোলাকার, তাই এর প্রাচীন নাম ছিল "মদিনাত আল-সালাম" অর্থাৎ "শান্তির শহর"। গোলাকৃতি নগর পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন বিশ্বের জন্য এক বিস্ময়, যেখানে শহরের কেন্দ্রস্থলে ছিল খলিফার রাজপ্রাসাদ ও প্রধান মসজিদ। এই কেন্দ্র থেকে প্রধান সড়কগুলো বিভিন্ন দিকের দিকে বিস্তৃত, যা একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিফলন।
বাগদাদের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত কৌশলগত স্থানে। এটি প্রাচীন সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বাণিজ্যিক দিক থেকেও শহরটি অচিরেই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বাণিজ্য, শিল্প ও কারুশিল্পে উন্নতি ঘটার পাশাপাশি শহরটি হয়ে ওঠে এক আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আল-মনসুর জ্ঞানচর্চার প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় অনুবাদ আন্দোলনের সূচনা ঘটে, যার মাধ্যমে গ্রীক, সিরিয়াক, ফার্সি ও হিন্দু গণিত, চিকিৎসা ও দর্শনের অমূল্য গ্রন্থসমূহ আরবি ভাষায় অনূদিত হতে থাকে।
এই অনুবাদ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে "বায়তুল হিকমা (House of Wisdom)" প্রতিষ্ঠিত হয় বাগদাদে। যদিও এটি আল-মনসুর পরবর্তী সময়ে খলিফা আল-মামুনের শাসনামলে পূর্ণতা লাভ করে, তবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন খলিফা আল-মনসুর। আল-মনসুর নিজেও পাণ্ডিত্যে পারদর্শী ছিলেন এবং বিজ্ঞজনদের সংস্পর্শে থাকতেন। তার দরবারে ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ খলদ ইবনে আবদুল মালিক, পারস্যের ঐতিহাসিক ইবনে আল-মুকাফফা, এবং হিন্দু জ্যোতির্বিদ কানাক। এসব জ্ঞানীদের সক্রিয় অংশগ্রহণেই বাগদাদ হয়ে ওঠে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত এক শহর।
খলিফা আল-মনসুরের শাসনকাল ছিল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একটি কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলেন, যেখানে মন্ত্রিপরিষদ, সেনা, রাজস্ব ও বিচার বিভাগ ছিল কার্যকর ও সংগঠিত। রাজস্ব আদায় ও ব্যয় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, টাকশাল ও মুদ্রানীতি সংস্কার এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে তার অবদান ছিল বিশাল। এসব ব্যবস্থাপনা শহরকে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে ইসলামি দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে।
আল-মনসুরের পর তাঁর উত্তরসূরিরাও বাগদাদকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেন, তবে তার ভিত্তিভূমি ও স্থাপত্য পরিকল্পনা এবং যে সাংস্কৃতিক ভিত্তি তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা-ই পরবর্তীকালের উজ্জ্বল ইসলামি সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে দাঁড়ায়। আল-মনসুর কেবল একজন রাজনৈতিক শাসক ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক রাষ্ট্রনায়ক, দার্শনিকমনস্ক সংস্কারক ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। তার বাগদাদ নির্মাণ ছিল কেবল একটি শহর গড়ার প্রচেষ্টা নয়; বরং ছিল একটি সভ্যতা নির্মাণের পদক্ষেপ।
অতএব, ইসলামি স্বর্ণযুগের যে সূচনা আমরা দেখি নবম শতাব্দী থেকে, তার স্বপ্নদ্রষ্টা খলিফা আল-মনসুর। বাগদাদের স্থাপত্য, পরিকল্পনা, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব প্রমাণ করে যে এই শহরের জন্ম কেবল একটি রাজধানীর অভিপ্রায়ে হয়নি, বরং তা ছিল এক মহান সভ্যতা ও গৌরবময় ঐতিহ্যের পাদপীঠ। বাগদাদ ছিল ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূর্যোদয়ের কেন্দ্র, আর এই সূর্যোদয়ের প্রভাত বেলায় যিনি পথ প্রদর্শক, তিনি আর কেউ নন, আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর।
Jahan