ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সালাম আদান প্রদানের ইতিকথা

প্রকাশিত: ২২:১০, ১৪ জানুয়ারি ২০২২

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সালাম আদান প্রদানের ইতিকথা

ইসলামকে বলা হয় শান্তির ধর্ম। আরবী ইসলাম শব্দের এক অর্থ শান্তি। আর মুসলমানরা পরস্পর অভিবাদন জানানোর জন্য যে সালাম ব্যবহার করে এর অর্থও শান্তি। মুসলিম শব্দের অর্থ শান্তির বার্তাবাহক। বাস্তবেই সালামের মাধ্যমে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের কাছে শান্তি ও নিরাপত্তার বার্তাটি পৌঁছে দেয়। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে হলে একজন আরেকজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইসলাম ধর্ম সে সুসম্পর্কটি গভীর থেকে গভীরতর করার জন্য সালাম বিনিময়কে সেতুবন্ধন হিসেবে নির্ধারণ করেছে। নিচের হাদিসটির মাধ্যমে আমরা সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি। বিখ্যাত হাদিস বিশেষজ্ঞ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন : ‘যার হাতে আমার প্রাণ সে সত্তার শপথ! তোমরা বেহেশতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমানদার হবে, আর ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না পরস্পর ভালবাসা স্থাপন করবে। আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজের কথা বলে দিব, যখন তোমরা তা করবে, পরস্পর ভালবাসা স্থাপিত হবে। তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রসার কর।’ (তিরমিযী ৫ম খন্ড)। এক মুসলমানের কাছে আরেক মুসলমান বা অন্য যে কোন ব্যক্তি হক বা অধিকার পেতে পারে। ইসলাম ধর্মে এ অধিকারকে বলা হয় ‘হাক্কুল ইবাদ’। হাদীস শরীফে মুসলমান পরস্পরায় ৬টি অধিকারকে বিশেষভাবে লালন করতে বলা হয়েছে। তন্মধ্যে, একটি হলো কারও সাক্ষাত হলে তাকে সালাম দেয়া। এ অধিকার প্রদান না করলে গুনাহগার হতে হয়। দীর্ঘ হাদিসটি নিম্নরূপ : হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমাদের নবীজী ইরশাদ করেছেন, এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের ৬টি কর্তব্য রয়েছে, সাক্ষাত হলে সালাম দেয়া, দাওয়াত করলে সাড়া দেয়া, হাঁচির জবাবে দোয়া করা, অসুস্থ হলে সেবা করা, মারা গেলে তার জানাজায় শরিক হওয়া এবং তার জন্য ঐ বস্তু পছন্দ করা যা নিজের জন্য পছন্দ করা হয়। (কোন কোন বর্ণনায় উপরোক্ত ৬টি বিষয়ের সঙ্গে আরও একটি বিষয় যোগ করা হয়েছে আর তা হলো, তার জন্য শুভ কামনা করা সে সামনে থাকুক অথবা অনুপস্থিত)।’ এ হাদিস থেকেও আমরা বুঝলাম, সালাম-আদান প্রদান একটি সামাজিক ইবাদত, কর্তব্য এবং ভদ্রতা। সালাম শব্দটি আল্লাহ পাকের ৯৯ নামের একটি। এদিক দিয়ে এটি আমাদের জবানের একটি উত্তম জিকিরও বটে। কুরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালার জন্য রয়েছে উত্তম নামসমূহ। তোমরা সেসব নামের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর।’ সূরা হাশরের মধ্যে আল্লাহর সালাম নামটি বিদ্যমান। সুতরাং মুখে এ সালামের চর্চা নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাকের বরকতের মধুঝরা একটি উসিলা। একইভাবে সালাম প্রদান যেহেতু হাক্কুল ইবাদ, সেহেতু এর অপব্যবহার কিংবা উদাসীনতার জন্য আমাদের অবশ্যই পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘আর তোমাদের যদি কেউ দোয়া করে, তাহলে তোমরাও তার জন্য দোয়া কর; তারচেয়ে উত্তম দোয়া অথবা তারই মতো ফিরিয়ে বল।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৮৬) জগতের প্রত্যেক সভ্য জাতির মধ্য পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের সময় ভালবাসা ও সম্প্রীতি প্রকাশার্থে কোন না কোন বাক্য আদান-প্রদান করার প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামী সালাম যতটুকু ব্যাপক অর্থবোধক, অন্য কোন সালাম ততটুকু নয়। কেননা, এতে শুধু ভালবাসাই প্রকাশ করা হয় না বরং সঙ্গে সঙ্গে ভালবাসার যথার্থ হকও আদায় করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয় যে, আল্লাহ আপনাকে সর্ববিধ বিপদাপদ থেকে নিরাপদে রাখুন। এ দোয়াটি আরবদের প্রথা অনুযায়ী শুধু জীবিত থাকার দোয়া নয়; বরং পবিত্র জীবনের দোয়া। অর্থাৎ, সর্ববিধ বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার দোয়া। এতে এ বিষয়েরও অভিব্যক্তি রয়েছে যে, আমরা ও তোমরা সবাই আল্লাহ তায়ালার মুখাপেক্ষী। তাঁর অনুমতি ছাড়া একে অপরের উপকার করতে পারি না। এ অর্থের দিক দিয়ে বাক্যটি একাধারে একটি ইবাদত এবং মুসলমান ভাইকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়ার উপায়ও বটে। ইবনে আরাবী আহকামুল কোরআন গ্রন্থে ইমাম ইবনে উয়াইনার এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, সালাম কি বস্তু তুমি জান? সালামকারী ব্যক্তি বলে, তুমি আমার পক্ষ থেকে বিপদমুক্ত। ইসলামেী সালামে বিরাট অর্থগত ব্যাপ্তি রয়েছে। যেমন : ১. এতে রয়েছে আল্লাহ তায়ালার যিকর ২. আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়া ৩. মুসলমান ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা ও সম্প্রীতি প্রকাশ ৪. মুসলমান ভাইয়ের জন্য সর্বোত্তম দোয়া ৫. মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে এ চুক্তি যে, আমার হাত ও মুখ দ্বারা আপনার কোন কষ্ট হবে না। আয়াতের বিষয়বস্তুর উপসংহারে বলা হয়েছে, ইন্নাল্লাহা আ’লা কুলি শাইয়িন হাসিবা অর্থাৎ, আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর হিসাব নিবেন। সালাম ও সালামের জবাব ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা এগুলোরও হিসাব নেবেন। (মাআরিফুল কুরআন, অখ- পৃ. ২৭১)। সালাম শব্দের সূচনা সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টি করে বললেন, যাও অবস্থানরত ফেরেশতাদের ঐ দলটিকে সালাম কর। আর শ্রবণ কর, তোমার দেয়া সালামের জবাবে তারা কি বলে। কেননা, এটা হবে স্বয়ং তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম আদান-প্রদান পদ্ধতি। তখন আদম (আ) সেখানে গিয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললেন। তারা জবাবে ‘আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বললেন (একটি অংশ বাড়িয়ে বললেন)। আল্লাহ তায়ালা মহানবী হযরত মুহাম্মদকে (সা) সম্বোধন করে বলেন : আর যারা আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করে, যখন তারা আপনার কাছে আসবে তখন আপনি বলে দিন, তোমাদের ওপর সালাম বা শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের পালনকর্তা রহমত করা নিজ দায়িত্বে লিখে নিয়েছেন...। (সূরা আল আনআম, আয়াত ৫৪)। আমরা দেখতে পাই যে, নবী রাসূলদের জীবন ইতিহাসে সালাম শব্দটি ব্যবহার হয়ে আসছিল। পবিত্র কোরআনে নবীগণের প্রতি সম্মান, সুসংবাদ, শান্তি ও রহমত হিসেবে সালাম শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। যেমনÑ নমরুদ হযরত ইব্রাহীম (আ) কে পুড়িয়ে মারার জন্য আগুনে নিক্ষেপ করলে আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে শান্তি ও রহমতের সুসংবাদ হিসেবে আগুনকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হে আগুন! ইব্রাহীমের প্রতি শান্তিদায়ক ঠা-া হয়ে যাও।’ (সূরা আম্বিয়া)। আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা ও হারুন (আ), হযরত ইলিয়াস (আ) ও হযরত ঈসা (আ) এর ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে সালাম শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এতদ্ভিন্ন জান্নাতবাসীদের ফেরেশতারা এবং আল্লাহ তায়ালা সালাম শব্দ দ্বারা স্বাগত জানাবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। সূরা ইয়াসীনে বর্ণিত হয়েছে, ‘করুণাময় পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হবে সালাম’। (আয়াত ৫৮)। সূরা ইউনুসে আরও বলা হয়েছে, সেখানে তাদের প্রার্থনা হলো, পবিত্র তোমার সত্তা হে আল্লাহ। আর শুভেচ্ছা হলো সালাম আর তাদের প্রার্থনার সমাপ্তি হয়, সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য বলে। (আয়াত ১০) লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব [email protected]
×