ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

ফোর-জি নাকি প্রযুক্তি বৈষম্য?

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৪ মার্চ ২০১৮

ফোর-জি নাকি প্রযুক্তি বৈষম্য?

দেশে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ফোর-জি ইন্টারনেট এসেছে। এই কথা শুনে এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, দেশে ফোর-জি আসেনি, ঢাকায় আসছে, তিন বছর পরে ঢাকার বাইরে যাবে। ঢাকাকে নিলামে নিয়ে মোবাইলওয়ালারা দেশ থেকে আলাদা করে দিল! সব দোষ আমাদের, কারণ আমরা সারাদেশে ন্যায্য দামে, উচ্চগতির ইন্টারনেট দাবি করি আর সব দোষ আমাদের কারণ আমরা সংখ্যায় বেশি আর ঢাকার বাইরে থাকি। ইংরেজীতে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বলে একটা কথা বেশ চালু ছিল ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। কথা ছিল কেমন করে দেশে দেশে প্রযুক্তির এই বিভাজন কমিয়ে আনা যায়। এই নিয়ে দুনিয়াজুড়ে নানারকম কাজ হয়। শ্রেণী বৈষম্য কমাতে যেমন দেশে দেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয় যার চাবিকাঠি ছিল সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর দার্শনিক সমাজের হাতে সে রকম ডিজিটাল ডিভাইড ঘুচাতে কোন ব্যবসায়ী বা বিজ্ঞানীদের পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে হাতেগোনা কয়েকজন কথা বলতেন যাদের মধ্যে নাইজেরিয়ার ফেন্টম ফাউন্ডেশন নামে এক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার একজন কর্মী (জন দাদা নামে সমধিক পরিচিত), যিনি ২০০০ সালে ইস্তাম্বুলে আইটিইউ-র ‘ইনফরমেশন সোসাইটি’ কেমন হতে পারে তার ঘোষণাপত্রে এই নিয়ে বিস্তর শর্তজুড়ে দেন। এর আগে কানাডায় ১৯৯৭ সালে গ্লোবাল নলেজ (জিকে) সম্মেলন হয় সেখানে চেষ্টা করেও ডিজিটাল ডিভাইডের চক্রাবর্ত নিয়ে কোন আলাপ করা যায়নি। ইস্তাম্বুলের ঘোষণার পরে ধনী দেশগুলো নড়ে চড়ে উঠে। ২০০০ সালের মে মাসে জাপানের ওকিনাওয়ায় জি-ফোর সম্মেলনে ক্লিনটন সাহেব এই নিয়ে প্রস্তাব তুলেন- যা পরে ডিজিটাল অপরচুনিটি টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে ২০০৩ সালে জাতিসংঘে এসে পৌঁছায়। একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করতে সবগুলো দেশের সময় লেগেছিল ৩ বছর। ২০০৫ সালে তিউনিসিয়ায় এই ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। বাংলাদেশ সেই ঘোষণাপত্র মেনে চলতে প্রতিশ্রুত। মালয়েশিয়ার তখনকার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ২০০০ সালেই জিকে-টু সম্মেলনের আয়োজন করে ডিজিটাল ডি-ভাইড দূর করতে বিশ্ব জনমত তৈরিতে কিছুটা সফল হন। ভারতের কয়েকজন উদ্যোগী ব্যক্তিত্ব এই সময়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন যাদের কাজের মাধ্যমে দুর্বল দেশগুলো উদাহরন তৈরি দেখাতে সমর্থ হয়। এক্ষেত্রে পন্ডিচেরীতে স্বামীনাথন ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘গ্রাম কেন্দ্র’ ও মধ্য প্রদেশের ধর জেলায় ‘জ্ঞানদূত’ প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নেপালে প্রায় একই সময়ে রেডিও সাগরমাথা কমিউনিটি রেডিও প্রচারের উদাহরণ তৈরি করে দক্ষিণ এশিয়ার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হাজির করে। ২০০২ সালের দিকে বাংলাদেশে আমাদের গ্রাম বাগেরহাট জেলার রামপালে ‘জ্ঞান কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ সঙ্কোচনে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। ডি-নেটসহ বেশকিছু সংস্থা ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে উন্নয়ন খাতে তথ্য-প্রযুক্তির ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট কার্যকরী উদাহরণ তৈরি করতে সমর্থ হয়। আমাদের গ্রাম ও ডি নেট এ সময়ে জাতিসংঘসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের আইসিটি পুরস্কার অর্জন করে। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রসারণ, ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিমালাগুলো খুব বেশিদিনের নয়। যেহেতু উদাহরণ তৈরিতে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় ফলে নীতিগুলো রচিত হতে খুব বেশি সময় প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা, সংশ্লিষ্ট ব্রডব্যান্ড নীতিমালা বা ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা নীতি আমরা হালনাগাদ করতে পারছি না। এর অন্যতম প্রধান কারণ এখাত সম্পূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রকদের হাতে চলে গেছে। ফলে উদ্ভাবনের নামে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা যেখানে প্রযুক্তির অসম বিস্তরণ ঘটেছে কিন্তু বিশ্ববাজারে উল্লেখ করার মতো কোন দৃষ্টান্ত আমরা তৈরি করতে পারছি না। প্রতিবছর ডব্লিউ এসআইএস যে পুরস্কার দেয় যার অনেকগুলো বাংলাদেশ সরকারের নানা প্রকল্পসহ কয়েকটি বেসরকারী উদ্যোগও পেয়েছে সেগুলো ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হিসেবে, উদ্ভাবন হিসেবে নয়। উদ্ভাবন হলে ইতোমধ্যে অন্তত একটি প্রকল্পে বাংলাদেশ স্টার্টআপ স্ট্যাটাস অর্জন করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারত। আমাদের মনোযোগ কেমন করে টাকার অঙ্কে হিসাব কষে দেখানো যায় আমরা কতদূর এগিয়েছি, কিন্তু আমরা এটা ভাবি না অন্যের কাজ করে দিয়ে টাকা বা মুনাফা অর্জন সব ক্ষেত্রে হলেও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে একে কোনভাবেই উদ্ভাবন বলা যাবে না। মিলিয়ন ডলারের হিসাব দিয়ে কী হবে যদি আমি প্রমাণ করতেই না পারি যে, আমাদের দেশের সব মানুষের কাছে ইন্টারনেট আছে, যারা কাজ করতে চায় তাদের কাছে চাহিদা অনুযায়ী উচ্চ গতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমরা এখনও আমাদের স্কুলগুলো পর্যন্ত ভালমানের ইন্টারনেট আর বিদ্যুত দিয়ে নিরাপদ রাখতে পারছি না, যাতে প্রশ্ন ফাঁসের মতো ভয়াবহ ঘটনা না ঘটতে পারে। আমরা বলতে পারছি না আমাদের ইন্টারনেট চাহিদা ঠিকমতো জানি কোথায় কী দরকার হবে আর আমরা তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। তা না করে, তরুনদের এক ভুল স্বপ্নে আমরা আঘোর বিপদে ফেলে দিচ্ছি। সবচেয়ে বড়ো ভুল করে ফেলেছি আবার, এতো সতর্ক কথার পরেও, উচ্চ গতির ফোর-জি আমরা দিচ্ছি শুধু ঢাকা শহরে, যা করে আমরা এতকাল পরে এত কাজ করেও ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে এখন থেকে পরিচিত হব। ঢাকার বাইরের তরুণদের আমরা প্রযুক্তি বৈষম্যের দেশের অবহেলিত ইন্টারনেট অধিকার নিয়ে ভেবে ভেবে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখব। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×