ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

প্রশ্নফাঁস ॥ কৃত্রিম শিক্ষাব্যবস্থার ফলিত রূপ

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রশ্নফাঁস ॥ কৃত্রিম শিক্ষাব্যবস্থার ফলিত রূপ

ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাকে সেই শুরু থেকেই সাধারণের নাগালের বাইরে রাখার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল টোল, চতুষ্পাঠী, পাঠশালার যুগ পেরিয়ে ইংরেজ আমলে তা আরও শাণিত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। শাসন-শোষণকে সুসংগঠিত প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার জন্য শিক্ষাকেও সুশৃঙ্খল কাঠামো দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কাজ তারা করেছিল কৃত্রিম উপায়ে। ইংরেজ শাসনের আগে ভারতে একক একটি শিক্ষা কাঠামো না থাকলেও পাঠশালার মধ্যে দিয়ে নিজস্ব শিক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞান দেয়া। নিজস্ব এ শিক্ষা পদ্ধতিকে বিকশিত করার সুযোগ না দিয়ে ইংরেজরা পাঠশালা ম্যানেজমেন্টকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় বাইরে থেকে একে ইউরোপীয় ধাঁচের কাঠামো মনে হলেও শিক্ষার অন্তর্গত রূপটি হয়ে পড়ে দাস মনস্তত্ত্ব¡ নির্ভর। ‘ভারতীয় মহা বিদ্রোহ’ বইয়ে প্রমোদ সেনগুপ্ত বিষয়টি এভাবে বলেছেন, ‘হাজিরা খাতা রক্ষা, ‘পাঠ্যক্রম বিন্যস্ত করা এবং বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন আসন নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা বোধ ছিল পাঠশালাসমূহকে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে পুনর্গঠনের ভাবনারই অন্তর্নিহিত দিক। ইংরেজ প্রবর্তিত নতুন শিক্ষারীতির বাহ্যরূপ ইউরোপীয় হলেও কার্যত তা হয়, ঔপনিবেশিক দাসতান্ত্রিক শিক্ষারীতি। অনিয়মিত উপস্থিতি ও ছাত্র বেতনের অনাদায়কে এ সময় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়, সনাতন পাঠশালা ব্যবস্থার মূল উপাদানই ছিল সারল্য ও আন্তরিকতা। ছাত্র-শিক্ষকরা কোন কড়া আইনের বাঁধনে বাঁধা ছিল না। কিন্তু এক্ষণে প্রথমবারের মতো বিশেষ অপরাধের জন্য বিশেষ শাস্তি দানের ব্যবস্থা করা হলো। গুরু ধীরে ধীরে একজন সামান্য সরকারী ভৃত্যে পরিণত হতে থাকলেন।’ এই ভৃত্যে পরিণত হওয়া শিক্ষকরাই নানা স্তরে এরপর যে শিক্ষা দিতে থাকলেন তা ভৃত্য মানসিকতাই তৈরি করল। শিক্ষার সামগ্রিক যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলো তা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্ব পেরিয়ে আমরা যখন বাংলাদেশ পর্ব পাড়ি দিচ্ছি শিক্ষা তখন পুঁজির নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি বিপণনযোগ্য পণ্য। শতকরা নব্বই ভাগ জিপিএ-৫ তাই পুঁজির প্রলোভনকে যত নিশ্চিত করে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য চিত্ত বিকাশের সম্ভাবনাকে ততই খারিজ করে। প্রায় কিছুই না পড়ে বা পাঠ্যবই সম্পর্কে সামান্য ধারণা নিয়ে এই যে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ বন্যায় ভেসে যাচ্ছে এর গুণগতমান নিয়ে দায়িত্বশীল প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে। আগে ভাল ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই মূল লক্ষ্য থাকত বিজ্ঞান গণিত বা অর্থনীতির মেজর ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করে শিক্ষার পরিপূর্ণতা উপলব্ধির দিকে। এখন এসব মৌলিক বিষয়ের দিকে আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। শিক্ষার মূল লক্ষ্য আবর্তিত জব অপরচুনিটি কেন্দ্র করে। তাই শিক্ষার্থীদের মূল মনোযোগ বিবিএ এমবিএ ইত্যাদির দিকে। শিক্ষা ব্যবস্থা জব অপরচুনিটি কেন্দ্রিক হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘চিত্ত বিকাশ’-এর পথ এখন প্রায় পুরোপুরি বন্ধ। চিত্তের বিকাশ মূলত হয় শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্র জীবনে। সে জীবন যদি পুরোটাই জিপিএ-৫-এর ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে পড়ে তা হলে তার পরিণাম অন্তঃসারশূন্য হওয়াই স্বাভাবিক। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য দেখাতে গিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানাচ্ছেন না তো? সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করে একটি ভাল উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে জিপিএ-৫ যেভাবে মহামারীর আকার ধারণ করছে তা আতঙ্কজনক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশ্নফাঁসের সংক্রমণ। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত এতে আক্রান্ত। বছর চারেক আগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মধ্যে লেখা পাল্টালেখা থেকে আমরা জেনেছিলাম মুহাম্মদ জাফর ইকবাল প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে ভয়ানক দুর্ভাবনায় আছেন আর শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে বলছিলেন, ‘আমরা ২০০৯ সাল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা গ্রহণ করছি। সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষা (ফল গত ১৭ মে প্রকাশিত হয়েছে) পর্যন্ত এ সময়ে একটি পরীক্ষারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এমন অভিযোগ ওঠেনি। যদিও এর আগে তা হয়েছে। কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করেছি। ২০১০ সালে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল, যা আমরা আগেই ধরে অপরাধীদের খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আমাদের কঠোর সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও এবারই প্রথম এইচএসসি পরীক্ষার এমন অচিন্ত্যনীয় ঘটনা ঘটেছে’ [যুগান্তর ২৬ মে ২০১৪]। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ ঘটনা ঘটে চললেও শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তারা এর কোন বিহিত করতে পারেননি। এখন তো শুধু প্রশ্নপত্র নয় প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরপত্র ফাঁসের ঘটনাও নিয়মিত। আর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কখনও কোন সংগঠিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিনা জানা নেই। বিভিন্ন ইস্যুতে এককভাবে অবস্থান কর্মসূচী পালন করে তাকে একটি স্বতন্ত্রধারা সৃষ্টির প্রতিই বেশি মনোযোগী মনে হয়েছে। লাইট ক্যামেরা এতেই তার চারপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে সময় কোন এক অজ্ঞাত কারণে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় জাতীয় দৈনিকগুলোতে তাঁর নিয়মিত কলামে লিখেছিলেনÑ ‘প্রশ্ন ফাঁসের একটি বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে, কোন একটি অজ্ঞাত কারণে সংবাদ মাধ্যম সেটি একেবারেই গুরুত্ব পায়নি। আমি ভেবেছিলাম এটি সংবাদপত্রে হেড লাইন হবে, হয়নি। ভেবেছিলাম টেলিভিশনে রিপোর্টের পর রিপোর্ট হবে, হয়নি। ভেবেছিলাম দেশের বিবেক যে শিক্ষাবিদেরা আছেন তারা কিছু বলবেন, বলেননি। ভেবেছিলাম শিক্ষা বিষয়ের এনজিওগুলো সোচ্চার হবে, তারা মুখ খোলেনি। আমার মনে হচ্ছে আমি বুঝি একা চিৎকার করে যাচ্ছি, শোনার কোন মানুষ নেই। আমি অনেক আশা করে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলাম, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। প্রশ্ন ফাঁসকে ‘সাজেশন’ বলে উড়িয়ে দিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত যে বড় কর্মকর্তারা প্রশ্নটা ফাঁস করলেন তাদের বিরুদ্ধে একটা কথা না বলে যারা এটা একে অন্যের কাছে বিতরণ করল শুধু তাদের দোষী সাব্যস্ত করলেন।’ প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে কেউ কোন কথা বলেননি বলে ড. ইকবাল মর্মাহত হয়েছেন। হওয়ারই কথা। যে শিক্ষার্থীরা শ্রম ও নিষ্ঠা নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশ্ন ফাঁস তাদের জন্য ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, গোটা শিক্ষা পদ্ধতির একটি উপসর্গ মাত্র। পদ্ধতির সামগ্রিক পরিবর্তনের চেষ্টা না করে শুধু একটি উপসর্গ দূর করার চেষ্টা করে সত্যিই কি সমস্যার সমাধান সম্ভব? ভারতীয় সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে ইংরেজরা যে চূড়ান্ত ক্ষতি করে গেছে একটি স্বাধীন ভূখ- পাওয়ার পরও আমরা সে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারিনি। তাদের নিজেদের দেশে সামন্ত তন্ত্রের অবসানের পর যখন নতুন বুর্জোয়া সমাজ গড়ে উঠছে সে সময় এখানে তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর নামে তৈরি করল একটি কৃত্রিম সামন্তগোষ্ঠী। রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর, নবাব, রাজা, মহারাজা উপাধি দিয়ে এ বন্দোবস্তের প্রতিনিধি হিসেবে একটি জমিদার শ্রেণীর আবির্ভাব হলো কিন্তু তাদের হাতে সামন্ত প্রভুর ক্ষমতা ছিল না। শাসন বা বিচার ক্ষমতা রইল প্রভু ইংরেজদের হাতে। সামন্ত প্রভুর মূল ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তাদের যা দেয়া হয়েছিল তা হলো লুটপাটের ক্ষমতা। স্বাভাবিকভাবেই ইংল্যান্ডে সামন্তবাদের স্বাভাবিক বিকাশের পর যেভাবে পুঁজিবাদ এসেছিল এখানে একেবারেই তা হয়নি। বিকৃতির সেই পথ ধরেই আজও চলছে এদেশের সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পৃথিবীজোড়া বাণিজ্য পুঁজির মুক্তপ্রবাহ। সুতরাং শিক্ষাকে স্বাভাবিক গতি পথে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন সামগ্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন।
×