ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হিজরী নববর্ষ ১৪৩৮ আহ্লান-সাহ্লান

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হিজরী নববর্ষ ১৪৩৮ আহ্লান-সাহ্লান

প্রতি বছর জিলহজ মাসের শেষ দিনের অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমাকাশে মহরম মাসের নতুন চাঁদ উদিত হয়ে হিজরী নববর্ষের আগমন বারতা ঘোষণা করে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পঙ্ক্তি তখন বারবার মনের কোণে উদিত হয়। কবি বলেন : ফিরে এলো আজ সেই মহরম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না। কবি আরও বলেছেন : ওরে বাঙলার মুসলিম, তোরা কাঁদ! এনেছে এজিদী বিদ্বেষ পুনঃমহরমের চাঁদ।... চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকার অন্তর্ভুক্ত অনন্য পবিত্রতার সৌরভ সুরভিত হিজরী নববর্ষ চন্দ্র পরিক্রমের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী আপন ঘূর্ণি গতিপথে ঘুরে ঘুরে আমাদের মাঝে আবির্ভূত হয় নব চাঁদ বা নও হেলালের উদয়ের মধ্য দিয়ে। হিজরী সনের প্রথম মাস মহরম। এই মহরমের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এই আশুরার দিনটি সৃষ্টির আদিকাল থেকে অনেক ঘটনার সাক্ষী হলেও সে সব ছাপিয়ে এদিন বিশেষভাবে মহিমান্বিত হয়েছে কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন আলাহিস সালামের শাহাদাতের কারণে। কারবালার সেই ট্র্যাজেডির কারণে হিজরী নববর্ষের প্রথম দিন আনন্দের হয় না, যেমনটা হয় পহেলা বৈশাখে কিংবা জানুয়ারির শুরুর মুহূর্তে রাত দুপুরের প্রচণ্ড শীতের মধ্যে। হিজরী গোড়াপত্তন হয় প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মনোয়ারায় হিজরতের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য। এই হিজরত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঐতিহাসিক জোসেফ হেল লিখেছেন : It is a turning point in the life and in the life and work of the prophet- the great turning point in the history of islam. –হিজরত প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবন ও কর্মে নতুন বাঁক আনয়ন করে, ইসলামের ইতিহাসে উন্মোচিত করে বৃহৎ দিগন্তের। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন : The Hijrah, with which the makkan period ended and the Madiness period began, proved a turning point in the life of Muhammad- হিজরতের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের অবসান ঘটে- যা তার জীবনে সূচিত করে এক নতুন দিগন্তের। আমরা জানি প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে মক্কা মুকাররমার পবিত্র হেরা গুহায় প্রথম ওহী লাভ করেন। তার তিন বছর পর আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁকে নির্দেশ দেন : ওয়া আনযির আশীরাতাকাল আকরাবিন- আপনার নিকট আত্মীয়স্বজনদের সতর্ক করে দিন। (সূরা শু’আরা : আয়াত ২১৪), ফাস্দা ‘বিমা তূ’মারু- অতএব আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তো প্রকাশ্যে প্রচার করুন। (সূরা হিজর : আয়াত ৯৪) গুটিকয়েক অতি সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া মক্কার কাফির –মুশরিকরা তাঁর আহ্বানে সাড়া তো দিলই না বরং তারা তাঁর প্রচারকার্যে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করতে লাগল, এমনকি সামাজিক বয়কট পর্যন্ত করল। কিন্তু তিনি তাঁর ওপর অর্পিত আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করা থেকে একটুও পিছু হটলেন না। কাফির মুশরিক নেতারা তাঁকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে কাবু করতে চাইল। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন : আমার এক হাতে চাঁদ আর এক হাতে সূর্য এনে দিলেও আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব পালন করতে দিয়েছেন তা থেকে কোন অবস্থাতেই বিরত হব না। ইতোমধ্যে ধীরগতিতে হলেও অনেক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ইসলামে দাখিল হতে লাগলেন। তবুও কাফির-মুশরিকদের অত্যাচারে নিত্য-নতুন মাত্রা সংযোজিত হতে লাগল। এক পর্যায়ে তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র কাফির-মুশরিকরা করল। রাতের অন্ধকারে তাঁর গৃহ ঘেরাও করল। আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাঁর বিছানায় হযরত আলী রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে শুইয়ে রেখে অতি সন্তর্পণে গৃহ থেকে বের হয়ে গেলেন এবং তাঁর নিত্য সহচর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর মাতুলালয় তদানীন্তন ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওনা হলেন। এর আগে তাঁর নির্দেশে মক্কা মুকাররমা অনেক সাহাবিই ইয়াসরিবে গিয়েছেন। যখন ইয়াসরিবে রটে গেল তিনি আসছেন। তখন সেখানকার প্রায় পাঁচ হাজার অধিবাসীর মধ্যে এক অনন্য আনন্দ আমেজ জেগে উঠল। কবিরা তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য কাসিদা রচনা করল। প্রায় পনেরো দিন ধরে দীর্ঘ ২৯৬ মাইল মরু-কঙ্কর পথ উটে চড়ে অতিক্রম করে তিনি ইয়াসরিবের উপকণ্ঠ কুবা নামক স্থানে উপস্থিত হলেন। এখানে কয়েক দিন অবস্থান করে, এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধসহ এক বিরাট আনন্দ মিছিল নিয়ে তিনি কুবা থেকে তিন মাইল দূরে ইয়াসরিব নগরীর দিকে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে বনি সালিম মহল্লায় সর্বপ্রথম জুমার নামাজ আদায় করলেন। মিছিল এগোনোর সময় নারী ও বালক-বালিকাদের কণ্ঠে সুললিত কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল : তালা’আলবাদরু আলায়না/মিনছানিয়াতিল বিদায়ী/ওয়াজাবাশ শুকরু ‘আলায়না/মা দা’আ লিল্লাহি দা’য়ী। সে এক হৃদয় উজাড় করা আনন্দ ফোয়ারা যেন প্রবাহিত হচ্ছিল। শত শত বালিকা সমবেত কণ্ঠে সুললিত উচ্চারণে বলছিল : ইয়া হাব্বাজা! মুহাম্মাদান মিন জারি- কি আনন্দ! মুহম্মদ আমাদের প্রতিবেশী হবেন। ইয়াসরিবে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রাচীন নগরীর নামকরণ হয়ে গেল মদিনাতুন নবী- নবীর নগরী যা এখন মদিনা মনোয়ারা-আলোকিত নগরী। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। তখন থেকেই হিজরতের প্রথম বছর, দ্বিতীয় বছর- এমনিভাবে বছরের হিসাব করা হচ্ছিল। এখানে উল্লেখ্য, তদানীন্তন আরব দেশে বারো মাসের বছর হওয়ায় প্রচলিত রীতি থাকলেও নির্ধারিত কোন সন বা বর্ষপঞ্জির হিসাব ছিল না। প্রিয় নবী (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন। এর প্রায় ৫০ দিন পূর্বে ইয়ামেনে খ্রীস্টান রাজা আবরাহা কা’বা শরীফ ধ্বংস করার কুমতলব এঁটে এক বিরাট হস্তিবাহিনীসহ মক্কার কাছাকাছি তিন মাইল দূরে এসে উপস্থিত হলে এক ঝাঁক আবাবিল পাখি ঠোঁটে কঙ্কর এনে সেই বাহিনীর ওপর এমন ক্ষিপ্রবেগে নিক্ষেপ করে যে, সমস্ত হস্তিবাহিনী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যায়। তখন থেকেই আরবদের কাছে আমূল ফিল বা হস্তিবর্ষ নামে একটি বর্ষ গণনা চালু হলেও তা প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করতে পারেনি। মদিনা মনোয়ারায় হিজরত করে আসার ফলে ইসলামের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী বিজয়ের নব নব অধ্যায় যেমন সংযোজিত হয়েছে তেমনি ইসলামের অনুশাসন পালনের নতুন বিধানও নাজিল হয়েছে। ইতোপূর্বেই সালাত কায়েমের বিধান নাজিল হলেও তা সুষ্ঠু ও নির্বিঘেœ আদায় করা শুরু হয়েছে হিজরত করে আসার ফলে। মসজিদুন্নবী কায়েম হয়েছে, যাকাত বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রমাদান মাসের সিয়াম মাসব্যাপী পালনের বিধান নাজিল হয়েছে, সম্পত্তি উত্তরাধিকারিত্ব বিধান নাজিল হয়েছে, হজের বিধান নাজিল হয়েছে- এমনিভাবে ইসলামের পরিপূর্ণতা এসেছে। যে কারণে হিজরত বিজয়ের একটি সুদৃঢ় মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়ে যায়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতকালে খিলাফতের বিস্তৃতি তদানীন্তন জানা পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি এলাকাজুড়ে ঘটে। বিভিন্ন প্রদেশেরে আমির বা গবর্নরদের কাছে চিঠিপত্র লেখার ক্ষেত্রে কিংবা নথি, ফরমান, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারিখ হিসেবে শুধু মাসের নাম লেখা হতো। নির্দিষ্ট কোন সন না থাকায় মাসের নামটি যে কোন্ বছরের তা বোঝা যেত না, ফলে দারুণ জটিলতার সৃষ্টি হতো। একটি প্রদেশের গবর্নর হযরত আবু মূসা আল-আশআরী রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু শুধু শা’বান মাস লেখা একটি চিঠির উল্লেখ করে লিখলেন : শুধু মাসের নাম লেখা থাকার কারণে দারুণ জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে হযরত উমর রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম সমন্বয়ে সন উদ্ভাবনের জন্য একটি বলিষ্ঠ কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হলো, কেউ বলেন : প্রিয় নবী (সা.)-এর পৃথিবীতে আবির্ভাবের বছর থেকে গণনা করে নতুন সাল প্রবর্তন করা হোক, কেউ বললেন প্রথম ওহী লাভের বছরের কথা, কেউবা ওফাতের বছরের কথা বললেন। কিন্তু হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু বললেন হিজরতের বছরের কথা। তিনি যুক্তিও দেখালেন। সবাই তা গ্রহণ করলেন। হিজরতের ১৭ বছর পর ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরী সনের প্রবর্তন হলো। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে হিজরতের ঘটনা ঘটলেও আরবের প্রচলিত মাসগুলোর ক্রম ঠিক রাখার জন্য প্রথম মাস মহরমের এক তারিখ থেকেই এই নতুন সাল গণনা নির্ধারিত হলো। বিশ্বে প্রচলিত সব চাইতে পবিত্র সাল হচ্ছে হিজরী সন এবং পৃথিবীর প্রায় দেড় শ’ কোটি মুসলিমের কাছে এ সন অতিপ্রিয়। কারণ এই সনের ১০ মহরম পালিত হয় আশুরা, সফরের শেষ বুধবারে আখেরি চাহার শম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী, ১১ রবিউস সানি ফাতিহায়ে ইয়াজদহম, ২৭ রজব লায়লাতুল মিরাজ, ১৫ শা’বান লায়লাতুল বারাআত, রমাদানের মাসব্যাপী সিয়াম, ২৭ রমাদান লায়লাতুল কদর, রমাদানের শেষ জুমা জুমাতুল বিদা, পহেলা শাওয়াল ঈদ-উল-ফিতর, ৮ জিলহজ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত মক্কা মুকাররমায় যাদের যাবার সামর্থ্য আছে তাদের জন্য হজ, ১০ জিলহজ সারা মুসলিম দুনিয়ায় পালিত হয় ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ। এখানে আরও উল্লেখ্য, ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরী সন প্রবর্তন করেন হযরত উমর ফারুক রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু। তার এক বছর পর অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। হিজরী সনের প্রতিটি মাস গণনা শুরু হয় চন্দ্র উদয়ের সময় থেকে। চাঁদ দেখার মধ্যেও একটা আনন্দ সৌকর্য রয়েছে, বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখায়। চাঁদ দেখার মধ্যেই এই সনের গুরুত্ব রয়েছে। এই মাস ২৯ দিনে কিংবা ৩০ দিনে হয়। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×