ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

গণতন্ত্রেরও ওপরে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সুরক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৭ এপ্রিল ২০১৫

গণতন্ত্রেরও ওপরে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সুরক্ষা

২০১৫-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধানত যে ক’টি সমালোচনা উঠে এসেছে, তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে- বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, দ্বিতীয় সমালোচনাটি হচ্ছে- ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম। তাই এ নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যায় না। সে কারণে দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন- এই বক্তব্য নিয়ে দেশী-বিদেশী খালেদাপ্রেমী সুশীলগোষ্ঠী, কূটনীতিকরা এ দেশে, তাদের দেশে, জাতিসংঘে তোলপাড় শুরু করে। এই বিষয় নিয়ে আমার ঘনিষ্ঠ আমেরিকান বন্ধুর সঙ্গে বিতর্ক হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সে আমার কিছু যুক্তি মেনে নিয়েছে এবং যুক্তিগুলো ভাবনা-চিন্তা করার মতো বিষয় বলে স্বীকার করেছে। আসলে পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গরা সহজে তাদের প্রিয়পাত্রের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তিও গ্রহণ করে না এবং প্রাচ্যদেশীয় মানুষ যতটা যুক্তিযুক্ত, পক্ষপাতহীন হতে পারে, ওরা তার অর্ধেকও নিরপেক্ষ হয় না। কিন্তু ওদের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ওরা খুব দ্রুত নিজেদের ভুল স্বীকার না করলেও অপরাধ স্বীকার করে এবং ফল, পরিণতি প্রতিবাদহীনভাবে দ্রুত গ্রহণ করে! যাই হোক, এই লেখায় আমার মূল বক্তব্য ছিলÑ কলুষিত গণতন্ত্রের চেয়েও যে কোন রাষ্ট্রের মূলভিত্তিÑ নীতি রক্ষা, জাতীয় সত্তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং তার স্বাধীনতাযুদ্ধের মূলনীতি, জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিকে জঙ্গী-মৌলবাদী আদর্শের হামলা থেকে রক্ষা করাÑ যা যে কোন দেশপ্রেমিক দল ও ব্যক্তির প্রথম এবং শেষ কর্তব্য বলে বিবেচনা করা উচিত। অবশ্য আরও অনেক বিষয়ের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেÑ যদি কোন দল, এ ক্ষেত্রে বিএনপি, সংবিধান নির্দেশিত সময়ে কোন স্বদেশী-বিদেশী গোষ্ঠীর বার বার অনুরোধেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তখন ওই আমেরিকানকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে তোমার দেশের সরকারে থাকা দলটি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করত? এটা তো জনগণ, দেশী-বিদেশী সরকার, কূটনীতিক, জাতিসংঘসহ সবাই প্রকাশ্যে প্রত্যক্ষ করেছে সরকার ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ হচ্ছে, জাতিসংঘ প্রতিনিধির নেতৃত্বে কোন কোন দিন মনে হচ্ছে, দুই দল একমত হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে ওই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারও কোন অদৃশ্য নির্দেশে! এভাবে চলতে চলতে একদিন জানা গেল সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অনেক ছাড় বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে প্রদান করার প্রস্তাব দেবার পরও শুধু তারেক রহমানের একটি নির্দেশে বিএনপি রাজনীতিকরা সমাধানের একেবারে কাছে এসেও পিছু হটে! এ তথ্যটি এখন ওপেন সিক্রেট! দেশী-বিদেশী সবাই জেনেছে যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং বিএনপি এতে অংশগ্রহণ না করলে প্রায় অর্ধেক সিট প্রতিদ্বন্দ্বীহীন থাকবে। যেহেতু চৌদ্দদলীয় জোটের বাইরে এবং জাতীয় পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য কোন পার্টি ছিল না এবং কমিউনিস্ট পার্টি বিএনপির মতো জামায়াতবান্ধব একটি দলের নির্বাচনে অনুপস্থিতির সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের যোগ্য, শিক্ষিত কিছু সদস্যকে জয়ী করে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করল না, তখন একমাত্র জাতীয় পার্টিই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রকৃত অর্থে দেশকে বিএনপি-জামায়াতের কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে দেশ ও জাতির প্রতি একটি বড় ধরনের দায়িত্ববোধের প্রমাণ দিয়েছে। আমেরিকা বা ইউরোপে একমাস-দেড়মাসের ‘নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা’ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন পরিচালনা করে, যাতে কোন দল ‘নির্বাচনে যাব না’ বলে গোসাঘরে খিল দেয়, তা সেসব দেশে কেউ কল্পনাও করতে পারে না! নির্বাচনে ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে ওসব দেশে প্রকাশ্যে চাঁদা গ্রহণ করা হয়, উচ্চ আদালতকে এবং এর বিচারকদেরও নীতিহীনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিদেশের ভোটগুলো ডাকবাক্সেই ফেলে রেখে ভোট কারচুপি করা হয়েছে, যদিও সেটি একবার মাত্র, জর্জ বুশের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার সময় সংঘটিত হয়েছে! তবুও এসব এবং আমাদের দেশে ২০০১-এ খালেদা-নিজামী-তারেক যেসব অকল্পনীয় উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান লতিফুর রহমানকে এবং তদানীন্তন নির্বাচন কমিশন প্রধান ও নির্বাচন কমিশনসহ সব নির্বাচনী ভোটকেন্দ্রকে সর্বোপরি নির্বাচনের দিন নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরে ভোটের হিসাবকে বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষে নিয়ন্ত্রিত করে নির্বাচনী ফল তৈরি করেছিল, সারাদেশে দলীয় ক্যাডার এবং সেনা সহায়তায় ’৭১-এর মতোই যে হিন্দু ও আওয়ামী লীগবিরোধী নির্যাতন-নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ, বসত-জীবিকা ধ্বংস করা হলো, যা চলেছিল ২০০৬ পর্যন্তÑ সেটি গণতন্ত্রের কোন্্ রূপ? তা নিয়ে কিন্তু পশ্চিমারা প্রশ্ন তোলেনি। আমার বিদেশী বন্ধুকে আমি যে একটি তথ্য দিয়ে চমকে দিয়েছিলাম এবং সে ওই বিষয়টি ভাবার মতো বলে স্বীকার করেছিল, এবার সে প্রসঙ্গে আসি। আমি ওকে বলেছিলামÑ বর্তমানের পেশী-অর্থভিত্তিক গণতন্ত্র তরুণ, দক্ষ, শিক্ষিত প্রজন্মের যে সেবা জাতির প্রয়োজন, তাদের কোন মতেই বিজয়ী করে সংসদে আনতে অক্ষম। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধী-মিত্র মুক্ত হওয়ায় কমপক্ষে এ রকম ত্রিশ-চল্লিশজন তরুণকে বর্তমান সরকারের দ্বারা বিজয়ী করে সংসদে স্থান করে নিতে সহায়ক হয়েছে! এটি সত্যিকার অর্থে একটি বিপ্লব। তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাদা-জঞ্জালপূর্ণ নির্বাচন যাতে মুক্তিযুদ্ধপন্থী তরুণকে ধনী যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মিত্রদের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতা করতে হয় এবং অবধারিতভাবে পরাজিত হতে হয়, সে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আজ কি গ্রহণযোগ্যতা, সক্ষমতা হারায়নি? তার কাছে আরও প্রশ্ন ছিলÑ ইউরোপে, আমেরিকায় কেন এখনও নাজি-সমর্থকরা নিষিদ্ধ? অথচ বাংলাদেশে, বাংলাদেশের নাজি দল জামায়াত-শিবিরকে, তাদের মিত্র বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য কেন পশ্চিমাদের এত আগ্রহ, এত উৎসাহ? যা তোমাদের দেশে নিষিদ্ধ, তা বাংলাদেশে কেন তোমাদের কাছে আদরণীয়? এই দ্বিমুখী আচরণ অগ্রহণযোগ্য, যেমন অগ্রহণযোগ্য খালেদার তিন মাসব্যাপী পেট্রোলবোমা দিয়ে নিরীহ মানুষ মারার প্রতি পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশ্চর্যজনক নীরবতা। আমেরিকান বন্ধু গণতন্ত্রেরই সীমাবদ্ধতা স্বীকার করল এবং এর একটি সমাধান, বিকল্প ব্যবস্থা ভাবার প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করল। আসলেই এখনকার প্রচলিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার কিছু সংশোধন, পরিমার্জন একান্ত প্রয়োজন। আমাদের ভাবতে হবেÑ কিভাবে, শিক্ষিত, দক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীদের দেশ গড়ার কাজে সাংসদ হিসেবে বিজয়ী করে নিয়ে আসা যায়। চাইলে কিন্তু গণতন্ত্রকেও উন্নত করা যায়। যেমন, আগে বিআরটিএকে দালাল-ঘুষমুক্ত করা অসম্ভব মনে হতো। কিন্তু এখন যখন আমরা গাড়ির সব রকম ফি নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিয়ে বিআরটিএতে লাইন দিয়ে এক ঘণ্টায় স্বহস্তে কাজটি সম্পন্ন করি, তখন একবার পরিবহনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিই যে, অসম্ভবকে উনি সম্ভব করেছেন। তেমনি ইচ্ছা থাকলে, ইচ্ছা থাকাই উচিত, গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিকেও সংশোধন করা যায়। কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রস্তাব প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হিসাবের ভিত্তিতে দল জিতবে, সেটিও গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব, যা অনেক দেশে প্রচলিত আছে। আরেকটি প্রস্তাবÑ এমন হতে পারে যে, ২০-৩০ শতাংশ সিট উচ্চশিক্ষিত (বিএ, এমএ’র নিচে নয়), পঞ্চাশ বছর বয়সের নিচে দলের ও স্থানীয় মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী তরুণ-তরুণীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা। এর ফলে, ধীরে ধীরে দেশ ও জাতি শিক্ষিত দেশপ্রেমিক, কাজে আন্তরিক এবং দক্ষ নেতৃত্ব লাভ করবে। গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে গণমানুষের কাছাকাছি সেবা পৌঁছে দেবার মাধ্যম হিসেবে রূপান্তরিত করা এখন সময়ের দাবি এবং তা করবে দেশপ্রেমিক শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাই এ তো বলাবাহুল্য। পরিশেষে তাই বলতে চাই, বর্তমানে বাংলাদেশ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেÑ তাতে গণতন্ত্রের আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে সুরক্ষিত করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা, দণ্ড দ্রুত কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধীবান্ধব খালেদা-তারেকের মানবতাবিরোধী সব অপরাধের বিচার ও দণ্ড কার্যকর করলে, জামায়াত-শিবির, জঙ্গী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে গণতন্ত্র ও নির্বাচন যে প্রায় ৮০ ভাগ পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। শতকরাভিত্তিক ভোট পেশী ও কালো টাকা দূর করবে এবং তরুণ-শিক্ষিত প্রার্থীদের জন্য সিট সংরক্ষিত রেখে গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে শতভাগ পরিচ্ছন্ন করাও সম্ভব হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×