ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বহু বর্ণিল চিরন্তন অনুভূতি

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বহু বর্ণিল চিরন্তন অনুভূতি

প্রেমিক কবিমাত্রই পরম ঈশ্বর!

প্রেমিক কবিমাত্রই পরম ঈশ্বর!
কবির করোটিতে ভাব-ভাষা আর আঙুলে ঝরনা আছে বলে তারাই কি লিখবেন প্রেমের সেরা কবিতাগুলো! বারবার প্রেমে পড়া, আমার মতো শত শত প্রেমের কবিতা লেখা প্রেমিক-কবি নয়, যারা কবিই নন, ২০২৪ সালের নবীন প্রেমিক এবং আধুনিক, তারাই লিখতে পারবেন সর্বোৎকৃষ্ট প্রেমের কবিতা; যাতে থাকবে সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থ’ূল বোকামি, সুগভীর রস, অগভীর বালখিল্যতা।

অবশ্যই স্মার্ট ফোন-যুগের, ধ্বনির পরিবর্তে টেক্সট দিয়ে হৃদয়-স্পন্দন বোঝানো, তারুণ্যই জানে প্রেমের কবিতার নতুন ভাষা, অভিনব প্রণয়-সঙ্গীত এবং চুম্বনের চৌষট্টি অজুহাত। আমার এমনটাই মনে হচ্ছে আজ। 
এখনও বুড়ো কবিরা আছেন যারা ভাবেন, ভালোবাসায় মনের স্থান শৃঙ্গচূড়ায়, তাতে দেহ মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওইসব হাদারাম প্লেটোনিকদের (আমিও কি ওই ক্লাবের মেম্বার নই!) পরিপূর্ণভাবে নাকচ করতে পারলে খুব খুশি হতাম। প্রেমের পঙ্ক্তির মতো অশরীরী নয় প্রেম, তার রয়েছে রক্তমাংসের আগুনের উত্তাপ, বিজ্ঞানসম্মত হরমোন রসায়নের রহস্যময়তা।

পঞ্চাশ পেরুনো প্রেমিকের প্রেমে পড়ার স্বল্পকালের মধ্যে প্রেমাষ্পদা বুঝে ফেলতে পারেন ভিমরতির আদ্যোপান্ত; রতিকর্মে কবিতার ফুল পাপড়ি না মেলা পর্যন্ত সেই প্রেয়সীরও কি স্বস্তি মেলে? আবার পুরো ৩৬৫ দিন প্রেমে নিমজ্জিত থেকেও প্রেমিকার হাতখানি ছোঁয়ার সুতীব্র তাগিদ নাও জাগতে পারে। এটাকে আপনারা কী বলবেন? প্রেম সেই উন্মাদদশা যা মানে নাকো কোনো আইন, যার সম্মন্ধে চলে না উনিশ-বিশ পূর্বাভাস। আর তার শ^াস থেকেই জন্ম নেয় চিরকালীন প্রেমের কবিতা। 
গানের সঙ্গে গদ্যের প্রেম, কবিতার সঙ্গে নৃত্যের আলিঙ্গন, জলরঙশিল্পীর সঙ্গে ফ্যাশন মডেলের ভালোবাসাÑ এসবের ভেতর যে বহুবর্ণিলতা আছে, যে যাদু ও বাঁক আছে, বাংলা প্রেমের কবিতা তা কি ধরতে পেরেছে ঠিকঠাক? মুশকিল হচ্ছে, প্রেমের কবিতা লেখেন না এলিয়েন, লেখেন সীমিত অভিজ্ঞতা আর সীমাবদ্ধ অনুভূতি সম্পন্ন ফতুয়া-পাঞ্জাবিপ্রিয় আধা সংসারী কবি; কল্পনাবিলাস যার প্রধান অবলম্বন। তারা যা লিখেছেন, তাতে আজ আর ‘এ আই’-জমানার প্রেমজুটি মজেন না।

এমন জুটি নিজেদের রাখেন সংগোপন আড়ালে, সামাজিকতার ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরে তাদের অবস্থান, তারা শুধু চেনেন দুজনার সৃষ্ট ছোট্ট ভুবন, যা রিসোর্টের কামরায় এঁেট যায়, উত্তরা টু মতিঝিল মেট্রোরেলের স্টেশনে-স্টেশনে ইশারায় শিস দিয়ে যায়। ইশ তারা যদি লিখতেন ইউনিভার্সিটির অ্যাসাইনমেন্ট খাতায় কবিতা কিংবা নেটে, তাহলে হয়তো বাংলা প্রেমের কবিতার ক্লিশেদশা কেটে যেত। প্রেম- নিজেই সে গরিব গ্রহের এক আশ্চর্য সুন্দর ধ্বনিময় কবিতা।

দুটি টলটলে থরথর উথালপাথাল হৃদয়ের নৈঃশব্দে নিহিত এক পরম প্রাণভোমরা। (আবার একটি হৃদয় নিষ্ক্রিয় ও মৌন রইলেও তুমুল সংঘটিত হতে পারে প্রেম!) প্রেমে পড়লে চতুর চ-ালও কবি। আর কবির প্রেম? সে তো মহার্ঘ্যবিশেষ, যার সুঘ্রাণ পায় প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ। প্রতিটি প্রেমই নতুন, বলতে পারি অভিনব। কিন্তু তার অভ্যন্তরে ফুটতে থাকা অনুভূতিগুচ্ছ সকলই পুরাতন। সেই চিরপুরাতনকে নতুন শব্দ ও বাকভঙ্গিমায় চিরনূতন রূপেই কবি আমাদের সামনে তুলে আনতে সক্ষম। তাই প্রেমিক কবিমাত্রই পরম ঈশ্বর!
সে যাক, আমরা বরং ফিরে আসি বাংলার প্রেমপতিত প্রথাগত প্রেমিক কবিদের চরণধ্বনিতে, যে-ভা-ার থেকে শব্দ ধার করে প্রেমপত্র লিখতেন ষাট থেকে নব্বুই দশক পর্যন্ত প্রেমপিয়াসি মন। কারা তাঁরা? অন্তত একজন আছেন, যিনি প্রেমস¤্রাট। বুঝে নিন কার কথা বলছি।

॥ দুই ॥   
প্রেমদর্শন প্রেমছন্দ
প্রেমÑ নিজেই সে গরিব গ্রহের এক আশ্চর্য সুন্দর ধ্বনিময় কবিতা। দুটি টলটলে থরথর উথালপাথাল হৃদয়ের নৈঃশব্দে নিহিত এক পরম প্রাণভোমরা। (আবার একটি হৃদয় নিষ্ক্রিয় ও মৌন রইলেও তুমুল সংঘটিত হতে পারে প্রেম!) প্রেমে পড়লে চতুর চ-ালও কবি। আর কবির প্রেম? সে তো মহার্ঘ্যবিশেষ, যার সুঘ্রাণ পায় প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ। প্রতিটি প্রেমই নতুন, বলতে পারি অভিনব। কিন্তু তার অভ্যন্তরে ফুটতে থাকা অনুভূতিগুচ্ছ সকলই পুরাতন। সেই চিরপুরাতনকে নতুন শব্দ ও বাকভঙ্গিমায় চিরনূতন রূপেই কবি আমাদের সামনে তুলে আনতে সক্ষম। 
প্রেমিক কখনো বালকও বটে (কিংবা বালিকা); প্রেমে পাগল হলে সেটাই সংগত। তবু পরিণত কবির প্রেমপঙক্তি চিত্রপটে ধরে রাখে প্রেমের দর্শন, সূক্ষ্ম সঞ্জিবনী। সেখানে প্রাজ্ঞের অভিজ্ঞতার শাঁস, আর প্রতারিতের পতনের ফাঁস মিলেমিশে থাকতে পারে। এখন আমি কী-বোর্ড থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ বন্ধ করে আবহমান বাংলার প্রেমের কবিতাসমুদ্রে পর্যটন করতে গিয়ে ছুঁয়ে যেতে পারছি ভালোবাসার ভুলগুলোকে, ফুলগুলোকে।

কবি নির্দিষ্টভাবে নিজের কথা বলেন প্রেমের কবিতায়, আবার পৃথিবীর বহু প্রেমিকের বহুল স্বরও বেজে উঠতে পারে তাঁর শব্দে। নিজেকে শত প্রেমিকের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেয়া, এবং শত প্রেমিককে নিজের মধ্যে ধারণÑ উভয়ই অসম্ভব নয়। অন্তত কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এমনটা অস্বাভাবিক মনে হয় না। বলতে চাইছি, প্রতিটি প্রেমের কবিতার নায়ক অবধারিতভাবে স্বয়ং কবিই হবেনÑ এটা স্বতঃসিদ্ধ নয়। তবু কবি যখন উচ্চারণ করেন, তা তাঁর নিজেরই জীবনের উচ্চারণ। অপরের প্রেমের অভিজ্ঞতা কবির নিজের ভালোবাসার উপলব্ধি না হলে তা কবিতা হবে কেন? একটি প্রেমকাব্য যদি প্রেমিকমাত্রেরই প্রেমকাব্য হয়ে উঠতে পারে (শতভাগ না হলেও) তবে সেটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের। কবির চরণকে আউড়ে বলা যায়, এ তো আমারই অভিজ্ঞতা, কবি! আমি লিখিনি, আপনি লিখেছেন। 
আচ্ছা প্রেমের কবিতার বেলায় অন্ত্যমিল কি জরুরি? না, জরুরি নয়। মানে অপরিহার্য শর্ত নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রেমের যে কবিতাগুলো আমাদের মনের ভেতর খোদিত হয়ে আছে, যেগুলো বহুল পঠিত, আবৃত্তিকারদের বাছাই-তালিকার শীর্ষে- সেগুলোর বেশির ভাগই পারফেক্ট ছন্দে লেখা এবং তাতে রয়েছে মধ্যমিল অন্ত্যমিল। মিল মানেই সংগীতই তাতে বেজে বেজে ওঠে। কবিতায় এই যে গীতলতা এসে প্রেমের পঙক্তিকে বাজিয়ে দিয়ে যায়, এটা ওষ্ঠের উচ্চারণ ও শ্রুতির সংবেদনের জন্য আরামপ্রদ। কে আরো কৌতূহলী করে তোলে অনাঘ্রাত রসাস্বাদনের আকাক্সক্ষায়। 

॥ তিন ॥
প্লেটোনিক প্রেমিক-কবির নিয়তি
কয়েক সহস্র কবিতার স্রষ্টা শামসুর রাহমানের পাঠকপ্রিয় কবিতার সংখ্যা অজস্র। সে-সম্ভারের মাঝখান থেকে কোন্ মনোটানাপড়েনে কোন্ কবিতা অপার্থিব শুশ্রƒষা দেবে, তা কিছুটা রহস্যঘেরা। তবু নেশা-নেশা ‘মাতাল ঋত্বিক’ কাব্যের প্রতি আমার পক্ষপাতের কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিগত বিহ্বলতা। সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থটি কবির কাছ থেকে সদ্যপরিচিত কবিতামাতাল এই আমার প্রথম উপহার পাওয়া। এটি কবিরও বিশেষ ব্যতিক্রমী কাব্য দুটি কারণে: নির্দিষ্ট থিমনির্ভর কবিতা সংকলন এটি এবং পুরোটাই চতুর্দশপদীর (সমিল-অমিল ও নিরীক্ষাময় প্রবহমান পর্বের) সমাহার। 
‘তোমাকে দিইনি আংটি’ ভাগ্যচক্রে দেশের প্রধান কবির খাতায় জন্ম নিয়েছে, অথচ এটি ‘আমার কবিতা’। কবিতায় দুটি চরিত্র- বিবাহসম্ভবা তরুণী ও মৌন প্রেমিক-কবি। তরুণীটি কবির বাগদত্তা নন। যদিও কবির মানসী তিনি, অথচ সেকথা তার জানাও হবে না কোনোকালে, অন্তত সরাসরি কবি প্রেমনিবেদন করবেন না। কবে তরুণী বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন, নির্ধারিত হয়নি। তবু কবি ভাবছেন সেই বিষণ্ণতম সন্ধ্যাটির কথা, সেদিন দগ্ধ হৃদয় নিয়ে কবি নিজেকে অন্তরীণ করবেন নিঃসঙ্গ বিনিদ্র কক্ষে - যেন খামার পুড়ে যাওয়া নিঃস্ব চাষী। 
প্রেম বহুবর্ণিল, বহুবিচিত্র; প্রেয়সীকে নিত্য আলিঙ্গনের ভেতরে পাওয়া এবং ভালোবাসার সন্তানদের নিয়ে এই নশ্বর জীবন ভোগে-উপভোগে অন্তিম দিনটির দিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া- এ তো সনাতন স্বাভাবিক মানবজীবনপরিধি। অথবা প্রেমে ব্যর্থতার হাহাকার নিয়ে জগৎকে দীর্ঘশ্বাসে পুড়িয়ে অদৃশ্য কান্নায় ডুবিয়ে দুঃখদীর্ণ জীবনযাপন! এমনও দৃষ্টান্ত ঢের আশেপাশে।

কিন্তু প্রেমাষ্পদাকে বিব্রত বিরক্ত না করে শুধু তাঁকে ভালো বেসে যাওয়া, তাঁর ভালো চাওয়া, শুধু তাঁর সুখ কামনা- এও তো একধরনের প্রেম, গভীর বিরল প্রেম; যা সর্বযুগেই নির্জলা আহাম্মকি, এক অসাধারণ উন্মাদগ্রস্ততা! এমন প্রেমে কে জড়ায় ছন্নছাড়া কবি ছাড়া? কবিই তো সবচেয়ে বড় বিবেচক প্রেমিক, যে জানে তাঁর নিয়তি হলো কঙ্কাল-কর্কশ সর্বনাশ, তাই সে যাকে ভালোবাসে তাকে কিভাবে টেনে আনে দিনানুদৈনিক নোংরা কাদাজলে; বস্তুগত অপ্রাপ্তির বাসিন্দা করে তোলে! বরং সে মাতাল আঙুলে স্বপ্নের ভেতরে কিছু ফুল তুলে যাক, চিরকাক্সিক্ষতার পুষ্পে আকুল স্বর্গীয় উদ্যান থেকে।  
বলেছি, ‘তোমাকে দিইনি আংটি’ আমার কবিতা; এখন বলছি এটি সব প্লেটোনিক প্রেমিক-কবিরই চিরকালীন ইশতেহার

[email protected]

×