ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

শিশুর মানসিক গঠনে এআই-এর হস্তক্ষেপ: প্রযুক্তির সঙ্গে শিশুর বেড়ে ওঠার ঝুঁকি

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ২৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ২১:৫০, ২৮ জুন ২০২৫

শিশুর মানসিক গঠনে এআই-এর হস্তক্ষেপ: প্রযুক্তির সঙ্গে শিশুর বেড়ে ওঠার ঝুঁকি

প্রযুক্তি আমাদের জীবন বদলে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের শিশুরা মানুষ হয়ে উঠবে, নাকি মেশিনের মতো আচরণ শিখে বড় হবে?

এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আজকাল কথা বলতে গেলে প্রায়ই চাকরির বাজারে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু একটা বিষয় থেকে যাচ্ছে একদম আড়ালে এই প্রযুক্তি ঠিক কীভাবে বদলে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শৈশব, তাদের মনন, আর হৃদয়?

অনেকেই ভাবেন, শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে AI-এর সম্পর্ক এখনো অনেক দূরের বিষয়। বাস্তবতা হলো, সেটি এখন আর ভবিষ্যতের ব্যাপার নয় AI আমাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠা, শেখা, এমনকি সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রেও ইতিমধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আজকের শিশুরা "অ্যালেক্সা" বলেই প্রথম কথা বলা শেখে, খেলনা বা টিভি রিমোটে কথা বলেও উত্তর পেতে চায়। আর যখন সেই প্রতিক্রিয়া আসে না, ওরা বিরক্ত হয়ে পড়ে।

সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি খেলনা কোম্পানি OpenAI-এর সঙ্গে চুক্তি করেছে। গবেষণা বলছে, এমনকি তিন বছর বয়সী শিশুরাও চ্যাটবটের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে অনেকটা তেমনভাবেই, যেমনটা তারা মা-বাবা বা আত্মীয়দের সঙ্গে গড়ে তোলে।

এদিকে টেক কোম্পানিগুলো দ্রুত নতুন প্রযুক্তি বাজারে ছাড়ছে। কিন্তু সেই প্রযুক্তির উপযোগিতা বা ক্ষতিকর দিক যাচাই করার মতো সময়ই নেই আমাদের হাতে। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো এই উদ্ভাবনগুলোর কেন্দ্রে শিশুর কল্যাণ নেই, বরং ব্যবসার লাভ।

ভাবুন, মেটার চ্যাটবটগুলোর কথা যেগুলো এমনকি অশালীন কথাবার্তাও চালাতে পারে, কখনও কিশোরের সেজে। কিংবা গুগল, যারা ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য AI চ্যাটবট আনতে চায়, অথচ শুধুই বলে দিচ্ছে, “আপনার সন্তান এমন কিছু দেখতে পারে যা আপনি চান না।”

এই মুহূর্তে মার্কিন সিনেট একটি আইন পাশ করতে যাচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে, আগামী ১০ বছর কোনো রাজ্য যেন AI প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে। অর্থাৎ, বাবা-মায়েরাই হয়তো আরেকটি সামাজিক পরীক্ষার অংশ হয়ে যাচ্ছেন তাঁদের সন্তানদের জীবন দিয়ে।

একজন শিশু চিকিৎসক ও গবেষক হিসেবে, যিনি শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে কাজ করেন, আমি এই পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কিত। শিশুর মস্তিষ্ক জীবনের প্রথম কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল থাকে বাইরের যেকোনো প্রভাবের প্রতি। অথচ আমরা এখনও জানিই না, শিশুকে AI-এর সঙ্গে বড় হতে দিলে তার মস্তিষ্ক ঠিক কীভাবে গঠিত হচ্ছে।

আমার সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, শিশুদের শেখার প্রক্রিয়া যদি এই ‘নিখুঁত’ মেশিন-বন্ধুদের উপর নির্ভর করে হয়, তাহলে ওরা কি আর বাস্তব জীবনের মানুষের ভুলত্রুটির সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারবে? বাস্তব জীবনের আবেগ, ভাঙচুর, অস্পষ্টতা এসব তো শেখায় আমাদের সহানুভূতি, মমত্ববোধ।

এই ভয়টা নতুন নয়। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রজন্ম দেখেছি, যারা ভার্চুয়াল সংযোগের মাঝে থেকেও নিঃসঙ্গতায় ভুগেছে। এবার সেই ভয় আরও তীব্র কারণ সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষমতাই যদি শিশুদের গড়ে না ওঠে?

বাচ্চারা বড় হয়ে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে শিখে, আর ছোটরা সেই যোগাযোগ গড়ার ক্ষমতা শেখে। এই তফাতটাই সবচেয়ে জরুরি। কিশোরদের জীবনে প্রযুক্তি এসেছে, কিন্তু ছোটদের জীবনে প্রযুক্তি যদি মূলে বসে যায়, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

তবে আমি সবকিছু নেগেটিভও দেখি না। AI-এর কিছু দিক আমাদের অভিভাবকদের জন্য সহায়ক হতে পারে। একজন কানের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জন হিসেবে আমি জানি, প্রযুক্তি অনেক সময় মানুষের জীবন আরও সহজ ও সুন্দর করে তোলে। ধরুন, একটি স্মার্ট বেবি মনিটর নতুন মায়ের ঘুমাতে সহায়তা করছে। অথবা একটি ছোট রোবট শিশুর সঙ্গে কথা বলছে, বারবার শব্দ শিখতে সাহায্য করছে। এসবই ভালো দিক।

কিন্তু সেটাই তো প্রশ্ন এই প্রযুক্তি শিশুর ব্রেনে নতুন সংযোগ তৈরি করছে, না কি সম্পর্ক গড়ার বদলে মেশিনে মগ্ন করে তুলছে?

আমরা প্রথমে বুঝতেও পারব না, কী হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো AI কিছু ক্ষেত্রে শেখার গতি বাড়াবে। কিন্তু প্রতিবার যখন আমরা শিশুর সঙ্গে কথা বলার বদলে রোবটের হাতে দায়িত্ব তুলে দিই, প্রতিটি স্পর্শের বদলে মেশিনের পর্দায় হাত রাখি, তখন একটা করে মানুষের মতো হয়ে ওঠার সুযোগ হারিয়ে যায়।

আমার গবেষণা বলছে, শিশুর মস্তিষ্ক শুধু শেখে না তা শিখে সম্পর্ক দিয়ে। মা-বাবার সঙ্গে ছোট ছোট ইঙ্গিত, চোখের ভাষা, মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া এই ‘অসম্পূর্ণতা’ দিয়েই গড়ে ওঠে শিশুর সহানুভূতি আর আত্মবিশ্বাস। আর মেশিন সে সুযোগটা দেয় না।

এখন সময় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকদের চোখ খুলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন প্রযুক্তি শিশুদের সাহায্য করছে, আর কোনটা বদলে দিচ্ছে তাদের মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।

একটা স্মার্ট খাট যদি শিশুর ঘুম ভালো করে, তাইলে সেটা চলতে পারে। কিন্তু যদি এমন টেডি বিয়ার আসে, যে গল্প বলে, গান গায়, আর মা-বাবার ভূমিকাও নিতে চায় তাহলে ভাবুন, ওটা কি আসলেই দরকার?

তবে শুধু অভিভাবকদের উপর দোষ চাপালেই চলবে না। দরকার সরকারের, গবেষকদের ও নীতিনির্ধারকদের হস্তক্ষেপ। দরকার বড় আকারের গবেষণা, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বয়সভিত্তিক সীমা ঠিক করা এবং AI বাজারে আসার আগেই যাচাই করা।

কারণ প্রতি মুহূর্তে যখন আমরা মানুষের বদলে মেশিন বসাচ্ছি, তখন একটা শিশুর মনোজগৎ নতুন করে গঠিত হচ্ছে। আর এই ছোট্ট মনেরাই ভবিষ্যতের সমাজ গড়বে সহানুভূতিশীল, মানবিক না কি নিঃসঙ্গ ও যান্ত্রিক, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের আজকের।

সূত্র:The Hill

আফরোজা

×