ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০

বিশেষ সংখ্যা

বিশেষ সংখ্যা বিভাগের সব খবর

আপন মহিমায় উজ্জ্বল

আপন মহিমায় উজ্জ্বল

আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেছি অসংখ্যবার কারণে বা অকারণে। কারণ থাকায় দেখা করলে মনে করতে হবে, পারস্পরিক স্বার্থ আছে। অকারণে দেখা করলে বুঝতে হবে একে অপরের পছন্দের এবং ভালোবাসার মানুষ। যেমন আমি আমার ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করতে যাই তাদেরকে ভালোবাসি বলে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কেবল দু’একবার ছাড়া সব সাক্ষাৎকারই ছিল অকারণে। কারণ থাকায় যে দু’একবার দেখা করেছি, তার থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি: ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসের এক বা দুই তারিখ। তখনকার সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকা অফিসে গেলাম। মালেকা আপা তখন ওই পত্রিকার সম্পাদক। তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, ১৫ আগস্টের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবেন। ওই বিশেষ সংখ্যায় শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার অর্থাৎ বক্তব্যই হবে প্রধান বিষয়। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি মালেকা আপাকে বললাম, চলুন যোগাযোগ না করেই যাই। আমিও যাব আপনার সঙ্গে। শেখ হাসিনা তখন ৩২ নম্বর রোডের বাসায় থাকতেন। ওখানে গিয়ে তাঁকে বাসায়ই পেলাম। মালেকা আপা শেখ হাসিনার বক্তব্য রেকর্ড করছিলেন। শেখ হাসিনা একটানা ৪০-৪৫ মিনিট খুব প্রাঞ্জল এবং স্বচ্ছভাবে কথা বলছিলেন। এমন দীর্ঘ সময় তাঁকে কথা বলতে দেখে ভাবছিলাম তিনি কতটা স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে পারেন! স্বচ্ছভাবে চিন্তা না করতে পারলে স্বচ্ছভাবে কথাও বলা যায় না।

আতিকউল্লাহ খান মাসুদ স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ

আতিকউল্লাহ খান মাসুদ স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ

গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা, দৈনিক জনকণ্ঠের প্রয়াত সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের ৭২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘বহুমাত্রিক এক জীবনযাত্রী’ শিরোনামে প্রকাশিত গ্রন্থটির সম্পাদক ও প্রকাশক জনকণ্ঠের সম্পাদক শামীমা এ খান। তিনিই মঙ্গলবার মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জন্মদিনে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।  দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বিচারপতি, আইনজীবীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের লেখা বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। আতিকউল্লাহ খান মাসুদের ঘনিষ্ঠজনরাও লিখেছেন বইতে। এসব লেখা তার বিগত জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রকাশিত জনকণ্ঠের বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। লেখাগুলো সংকলন করে এবার বই আকারে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া হলো।  বইয়ের লেখকদের একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে দেখেছেন। তাদের দেখার অভিজ্ঞতা, একসঙ্গে পথচলার স্মৃতি, নির্মোহ মূল্যায়ন বইটিকে  যেমন তথ্যপূর্ণ করেছে, তেমনি করেছে সুখপাঠ্য। ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা হয়েছে বইতে। এ সব লেখার মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে আরও গভীরভাবে জানার সুযোগ পাবেন পাঠক।  প্রাসঙ্গিকভাবেই এ বইয়ের আলোচনার বিষয় হয়ে এসেছে আধুনিক সংবাদপত্র শিল্পের অগ্রযাত্রার ইতিহাস, বহুবিধ চ্যালেঞ্জ, দৈনিক জনকণ্ঠের হাত ধরে আসা বৈপ্লবিক পরিবর্তন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক লড়াই, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা। এ জায়গা থেকে দেখলে বইটি শুধু ব্যক্তি আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে নয়, বরং তার ঘটনাবহুল সময়কাল ও কীর্তি সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিয়েছে।    আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ১৯৭১। বীর মুক্তিযোদ্ধা সেই সময় ও সময়ের দাবির কথা জীবদ্দশায় লিখে নিবন্ধ আকারে লিখে গিয়েছেন। তার নাতিদীর্ঘ লেখা এ বইয়ের খুবই উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ‘যুদ্ধ দিনের স্মৃতি’ শীর্ষক লেখায় অস্ত্র হাতে লড়াইয়ের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন অকুতোভয় যোদ্ধা। এ ছাড়া বইটিতে স্থান পেয়েছে তার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের একগুচ্ছ আলোকচিত্র। সব মিলিয়ে আতিকউল্লাহ খান মাসুদের স্মৃতি সংরক্ষণে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আশা প্রকাশনা সংশ্লিষ্টদের।  বইয়ের সম্পাদকম-লীতে রয়েছেন জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক ওবায়দুল কবির, ফিচার সম্পাদক মারুফ রায়হান, সহকারী সম্পাদক তাপস মজুমদার এবং সহিত্য সম্পাদক মিলু শামস। বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমীন। অলঙ্করণ করেছেন মফিজুর রহমান।  লেখক তালিকাটি অনেক দীর্ঘ। এ তালিকায় রয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ। আছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিশিষ্ট অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ সেনগুপ্ত, গায়ক ফেরদৌস ওয়াহীদ। লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো. আখতারুজ্জামান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কবি ড. মুহাম্মদ সামাদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিবিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। আতিকউল্লাহ খান মাসুদের অবদানের কথা লিখেছেন সিনিয়র সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, মনজুরুল আহসান বুলবুল, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সাবেক ফুটবলার হাসানুজ্জামান খান বাবলু, লেখক খুররম মমতাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ, সিনিয়র সাংবাদিক প্রয়াত রণেশ মৈত্র, লেখক মমতাজ লতিফ, সাবেক বৈমানিক ও লেখক আলমগীর সাত্তার, ব্যবসায়ী নেতা জসিম উদ্দিন, সাবেক কূটনৈতিক ওয়ালিউর রহমান। কর্মসূত্রে কাছ থেকে আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে দেখার অভিজ্ঞতা লিখেছেন সিনিয়র সাংবাদিক রেজোয়ানুল হক, ওবায়দুল কবির, মোয়াজ্জেমুল হক, মারুফ রায়হান, ইলিয়াস খান, দেলওয়ার হোসেন, কামরুল হাসান, মাহমুদ হাফিজ, শেখ সাইফুর রহমান, কাওসার রহমান, সালাম মাসরুর, উত্তম চক্রবর্তী, মজিবুর রহমান, সমুদ্র হক, মোরসালিন মিজান, মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, শিউলী আহমেদ, হাসান নাসির প্রমুখ।  ২৪৪ পৃষ্ঠার বইয়ের মূল্য ৩০০ টাকা। জনকণ্ঠের উদ্যোগে প্রকাশিত বইটি মুদ্রিত হয়েছে গ্লোব প্রিন্টার্স লিমিটেড থেকে। অঙ্গসজ্জা করেছেন মফিজুর রহমান। সহসাই বইটি সারাদেশের উল্লেখযোগ্য লাইব্রেরিগুলোতে পাওয়া যাবে।

সংবাদপত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

সংবাদপত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেকেলে সংবাদপত্র ব্যবস্থা সংস্কার করে আধুনিক সংবাদপত্রের গোড়াপত্তনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেই সঙ্গে সংবাদপত্রের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে তাঁর ভূমিকা যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ মনে রাখবে।  বাংলাদেশের আধুনিক সংবাদপত্রের জনক বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের আজ মঙ্গলবার ৭২তম জন্মবার্ষিকী। নীতির প্রশ্নে আপোসহীন, সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন এই মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক ১৯৫১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ভারতের বর্তমান মিজোরাম প্রদেশের লাংলী জেলার ডিমাগিরি নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ দবির উদ্দিন খান চাকরি করতেন ভারতীয় বন বিভাগে। চাকরি সূত্রে তিনি সপরিবারে থাকতেন ওখানে।  আতিকউল্লাহ খান মাসুদের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করা। স্বাধীনতা যুদ্ধে ২নং সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেন এবং অনেক বড় বড় অপারেশনে অংশ নেন। যুদ্ধকালে সব দুঃসাহসিক কর্মকা-ের কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।  বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ একজন প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবসময় নিজেকে এবং তার প্রকাশিত সংবাদপত্রকে নিয়োজিত করে গেছেন। নীতির প্রশ্নে আপোসহীন এবং ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল থাকাÑ এই কর্মবীর তার সারা জীবনের কাজ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। তাই তো তিনি বাংলাদেশের নির্ভীক সাংবাদিকতার এক পথিকৃৎ।  প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশে ১৯৯৩ সালে তিনি পাঁচটি স্থান থেকে একটি জাতীয় দৈনিক প্রকাশ করে সংবাদপত্র শিল্পে এক বিপ্লব সাধন করেন। তার দেখানো পথেই আজ দেশের সংবাদপত্র শিল্প উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সফল সংযোজন হচ্ছে ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ প্রকাশ। দেশে তখনো বাংলা ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তরে ধারণ করে এমন পত্রিকা তেমন একটা ছিল না। দৈনিক জনকণ্ঠই প্রথম বাংলাদেশের আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছে।  শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তরে ধারণই নয়, আতিকউল্লাহ খান মাসুদই দেশে প্রথম প্রযুক্তিভিত্তিক পত্রিকা বের করার কথা চিন্তা করেন। প্রযুক্তিতে ৩২৪ বছর পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল এক অনন্য অগ্রযাত্রা। কারণ, তখনো দেশে অনলাইন ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নি। ফলে নেটওয়ার্ক তৈরি করে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তথ্য স্থানান্তর করা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। সেই অকল্পনীয় কাজটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা।

দেশপ্রেমিক মানুষের সান্নিধ্যে...

দেশপ্রেমিক মানুষের সান্নিধ্যে...

দেশের প্রয়োজনে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়েই জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সঙ্গে পরিচয়। আমরা তখন স্বৈরাচার সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করছি। ছাত্রদল নেতা খায়রুল কবীর খোকনের মাধ্যমে তিনি একদিন নিজ কার্যালয়ে আমাদের চায়ের আমন্ত্রণ জানান। তখনো জনকণ্ঠ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ হয়নি। গ্লোব মশার কয়েল, গ্লোব কোম্পানি নামে পরিচিত। তিনি তখন এর প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরিচয় পর্বের পর আমাদের সঙ্গে তাঁর একটি আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর প্রায়শই দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় আমাদের অফিসে আমন্ত্রণ জানাতেন। তাঁর কার্যালয়ের পাশেই ‘ঘরোয়া’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানের খিচুড়ি ঢাকার প্রসিদ্ধ খাবারের তালিকায়। আমরা একসঙ্গে খেতাম এবং আন্দোলন সম্পর্কে মতবিনিময় করতাম। তিনি আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের নানা পরামর্শ ও উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। এর মধ্যে দেশের ছাত্র সমাজ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে এককেন্দ্রে নিয়ে আসে। দেশের ২২টি ছাত্র সংগঠন ও ডাকসু মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়। আন্তরিকতা থেকে তিনি অনেকটা আমাদের অভিভাবকের মতো হয়ে ওঠেন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে যাতে বিরোধপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি না হয় এবং আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি সেদিকে দৃষ্টি রাখতেন এবং আমাদেরকে নানা পরামর্শ দিয়ে তিনি সহযোগিতা করতেন।   ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকারকে আমাদের পক্ষ থেকে কী পরামর্শ দেয়া যায়, তা বলে দিতেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। এর পর পরই তিনি দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বিস্তারিত তুলে ধরেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। জানান, নতুন ধারণা নিয়ে আসা প্রকাশিত কাগজটি একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে সকল বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশ করতে চান তিনি। এতে কাগজের কাটতি বাড়বে। দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন। আমরা তাঁকে সহযোগিতার আশ^াস দেই। জনকণ্ঠ প্রকাশের পর সম্পাদক হিসেবে তিনি আবারো আমাকে ডেকে ৯০-এর ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পত্রিকায় লিখতে বলেন। তখন জনকণ্ঠে চতুরঙ্গ পাতার দায়িত্বে থাকা সাংবাদিক এখলাস ভাইকে দায়িত্ব দিলেন আমার লেখা ধারাবাহিকভাবে ছাপানোর জন্য।

আগস্ট আসে শপথ আর সতর্কতার বার্তা নিয়ে

আগস্ট আসে শপথ আর সতর্কতার বার্তা নিয়ে

পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচে রইলেন শেখ হাসিনা। আঁধার পথের যাত্রী হিসেবে রয়ে গেলেন আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। সর্বহারা দুবোন- কে কাকে দেয় সান্ত¦না। ছোট বোনের কথা ভেবে কান্না লুকিয়ে, চাপা কান্না বুকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অভিনয় করে গেলেন তিনি। বুকে পাথর চাপা দিয়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তরের অনন্ত চেষ্টা। সময় ছিল বড় নিষ্ঠুর! যে দেশের জন্য তাঁদের এত ত্যাগ সে দেশ তাদের নিষিদ্ধ হলো। মা, বাবা, ভাই-ভাবি আত্মীয় স্বজনসহ পরিবারের সকল সদস্যকে হারালেও প্রিয়জনের কবরের পার্শ্বে গিয়ে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করার অধিকারও তাদের ছিল না। একদিন নয় দুদিন নয়, সপ্তাহ নয় মাস নয়, বছর নয় অর্ধযুগ বাবা-মা-ভাইদের কবরের পাশে যেতে পারেননি তারা।

১৫ আগস্টের নির্মম শোকগাথা

১৫ আগস্টের নির্মম শোকগাথা

আমি বিয়ে করেছিলাম ১৯৬৫ সালে। বিয়ের পর পাঁচ-সাত বছর আমাদের বিবাহিত জীবন মোটামুটি সুখেরই ছিল। কিন্তু এরপর ওই সম্পর্ক আর তেমন সুখের রইল না। দোষটার ৮০ শতাংশের জন্য আমিই ছিলাম দায়ী। ১৯৭২-’৭৩ সাল থেকে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ওই সময় আমি ছিলাম বাংলাদেশ বিমানের এবং ২৭ অ্যারোপ্লেনের ক্যাপ্টেন। ডমেস্টিক  ফ্লাইট করতাম। তারপর আড্ডা দিতাম, তেজগাঁও বিমানবন্দরের ক্রুরুমে। বিমানবন্দরের ক্রুরুমে তাসের জুয়ার আসর বসত সকাল দশটা-সাড়ে দশটা থেকে। ফ্লাইট করার জন্য সকাল বেলায় বাসা থেকে বেরিয়ে যেতাম। তারপর বসতাম জুয়ার আড্ডায়। খাবার আসত বিমানবন্দরের রেস্তরাঁ থেকে। রেস্তরাঁর পাশেই ছিল একটা মদের দোকান। বিকেল বেলায় শুরু হতো খানা-পিনা, জুয়ার আড্ডা এবং একই সঙ্গে মদ্যপান। আমার ধূমপান এবং মদ্যপানের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফিরতাম রাত বারোটায়। বাসায় এসে ঘুমিয়ে যেতাম। আমার স্ত্রীকে আমি সময় দিতাম না। আমার তখন দুটি সন্তান ছিল। তাদেরও সময় দিতাম না। আমার ও স্ত্রীর মধ্যকার তিক্ত সম্পর্কের মূলে ছিল তাকে সময় না দেওয়া। অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য আমার চরিত্রের প্রতি তার সন্দেহ প্রবণতা বা ঈর্ষাপরায়ণতা দিন দিন বাড়তে লাগল। ভালোবাসা যত তীব্র হয়, ঈর্ষাপরায়ণতাও নাকি ততটা বেশি হয়। আমার স্ত্রীর ঈর্ষাপরায়ণতার একটি উদাহরণ দিচ্ছি- ১৯৭২-’৭৩ সালে আমার বাসা ছিল এলিফ্যান্ট রোডের একটি দোতলা ভবনে। রাস্তার উল্টো দিকে পশ্চিম পাশে ছিল একজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রীর বাসা। তিনি ছিলেন খুব সুন্দরী। আমি যদি পশ্চিম পাশের বাসার দিকে তাকাতাম তবে আমার স্ত্রী খুব রেগে যেত। অর্থাৎ পশ্চিম দিকে তাকানো আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আমার ওই স্ত্রী ১৯৯০ সালে মারা যায়। কিন্তু পশ্চিম দিকে না তাকানোর অভ্যাসটা এখনো আমার রয়ে গেছে। ॥ দুই ॥ আমার শ্বশুর দেশ বিভাগের আগে কলকাতায় একটি চাকরি করতেন এবং মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধুও তখন মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। আমার শ্বশুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার শ্বশুর খুলনার বি কে হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন এবং একই সঙ্গে শান্তি কমিটির একজন সদস্যও ছিলেন। পাকবাহিনীর সহায়তায় তিনি খুলনা শহরে একটি হিন্দুবাড়ি দখল করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই তিনি যখন বুঝলেন পাকবাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন তিনি খুলনা থেকে পালিয়ে এসে আমার ঢাকার বাসায় আশ্রয় নিলেন।  বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর গুণগান করে এবং স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লিখলেন। এরপর একদিন সুযোগ বুঝে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বললেন-দেখুন, আমি খুলনায় গেলে, আপনার আওয়ামীপন্থিরা আমাকে শান্তি কমিটিতে থাকার জন্য মেরে ফেলবে। আমি বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাব? বঙ্গবন্ধু তাকে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তার অধীনে দুজন সাইন্টিফিক অফিসারও দিলেন। সায়েন্স ল্যাবরেটরির ভেতরে নিরাপদে থাকার জন্য তাকে কোয়ার্টারও দেওয়া হলো। বিষয়টাকে আমি বলব, এটা বঙ্গবন্ধুর বিশেষ ক্ষমা এবং তাঁর মহত্ত্ব প্রকাশের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

প্রভাত ফেরীতে মুজিব

প্রভাত ফেরীতে মুজিব

একুশের প্রভাত ফেরীতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছেন মুজিব। সূর্যের হালকা আলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। লেকের ওপরে আবছা কুয়াশা। এক মুহূর্ত লেকের সামনে দাঁড়ান। বুকের ভেতরে শহীদদের চেহারা প্রতিবাদী চেতনায় ফুটে থাকে। যে কয়জন শহীদ হয়েছেন তাঁদের স্মরণে তাঁর হাতে সে কয়টা লাল গোলাপ। রাস্তার মাথার দিকে তাকিয়ে দেখেন ফুল নিয়ে পথযাত্রায় নেমেছেম ানুষ। তাঁর রাজনীতির কর্মীরা অনেকে তাঁর সঙ্গে পথে শামিল হবে। অনেকে শহীদ মিনারের সামনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে। হাতের গোলাপ নাকে ধরে নিজেকে বলেন, তোমাদের স্মরণে বুকের ভেতর রক্ত গোলাপ ফোটে সোনার ছেলেরা। তোমরা মাতৃভাষার জন্য আমাদের ইতিহাস সৃষ্টি করেছ। তোমরা অমর, তোমরা অমর। রাস্তার মাথায় এলে দেখতে পান কবি সুফিয়া কামাল দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একুশের ভোরে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেন। মুজিব তাঁর কাছে গেলে সুফিয়া কামাল বলেন, তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি ভাই। তোমার সঙ্গে পায়ে হেঁটে যেতে পারলে গর্ব হয়।  আহারে, আমার আপাটা এরকম করে হেঁটে যাবে? আপনি হেঁটে যাবেন না। আপনি রিকশায় যান। আমরা হেঁটে যাই।  না ভাই, আমি হেঁটে যেতে পারব। তোমাদের সঙ্গে হাঁটলে আমার কষ্ট হয় না। তুমি থাকলে তো আমি রিকশায় উঠবইনা। চলো যাই। তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।  মুজিব হাসতে হাসতে বলে, ‘ও আমার দেশে রমাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’আপা আপনি কবি। আন্দোলনে সক্রিয় থাকেন। দেশের জন্য আপনার চিন্তা অনেক গভীর। আপনার কবিতাপড়ে আমি মুগ্ধ হই।  চলো, চলো।  আমরা রোদ ওঠার আগেই পৌঁছে যাব শহীদ মিনারে।  মিছিলের আরও অনেকেই একসঙ্গে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিকই। আমাদের ফুলের তোড়ার গায়ে রোদ লাগবে না। ফুল শুকিয়ে যাবেনা।  সুফিয়া কামাল জোরে জোরে বলেন, আমরা কখনো শুকনো ফুল শহীদ মিনারে দেবনা। আমরা কখনো দেইনি। আমাদের তরতাজা ফুলের সৌরভ শহীদের রক্তে মিশে যাবে।  তখন ভেসে আসে গানআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিআমি কি ভুলিতে পারি গানের বাণী-সুরে ভরে যায় প্রভাত ফেরী। সূর্যের আলো বাড়ছে, এখনো তেমন রোদ ছড়ায়নি। মুজিব সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইতে থাকেন। ততক্ষণে সবাই নীলক্ষেতে চলেএসেছে। পায়ে হেঁটে গেলে আর বেশি দূর নয়। একজন ছেলে কাছে এসে বলে, মুজিব ভাই মওলানা ভাসানী যাচ্ছেন। আপনি এগিয়ে গেলে ওনার সঙ্গে দেখা হবে।  না, আমার আপাকে ছেড়ে আমি তাড়াতাড়ি হাঁটব না। আপা পিছিয়ে পড়তে পারেন।  সুফিয়া কামাল মুখ ঘুরিয়ে বলেন, একুশের প্রভাত ফেরী আমার প্রাণের টান। আমরা দুইজনে ধানম-ির বত্রিশ নম্বর রাস্তা থেকে রওনা করি। আমাদের ঠিকানা যেমন কাছাকাছি, তেমন চিন্তা-চেতনার দিকও একই রকম। ঠিক বলেছেন আপা। আপনি কবি-রাজনীতিবিদ। আর আমি রাজনীতিবিদ-কবি।  পাশের দু’একজন হাসতে হাসতে বলে, এখন থেকে আমরা আপনাকে মুজিব ভাই না ডেকে, কবি ভাই ডাকব।  তা হবে না, আমার রাজনীতি আগে। আর সুফিয়া কামাল আপার কবিতা আগে। যেখানে রাজনীতির সংগ্রাম সেখানে তিনি সামনে গিয়ে দাঁড়ান। ঠিক বলেছি আপা?  একদম ঠিক। মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আমি পিছিয়ে থাকতে চাই না। রাজপথে মিছিলে-মিটিংয়ে অংশ নিয়ে প্রতিবাদ করতে চাই।  আপনারা আমাদের আলোর পথের মানুষ। আপনাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করব কবি আপা। চলেন এগোই।  হাঁটতে শুরু করে সবাই। বিশ^বিদ্যালয় এলাকা পার হওয়ার আগেই বাবুপুরা বস্তির একটি দশ বছরের ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে মুজিবের পা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে ডাকে, মুজিব ভাই, মুজিব ভাই।  কি রে সোনারা কি হয়েছে?  আমরা আপনার সঙ্গে শহীদ মিনারে যাব।  চল, চল, আয় আমার সঙ্গে।  আমার হাতে ফুল নাই। শহীদ মিনারে তো আজকে ফুল ছাড়া যাওয়া যাবে না।  মুজিব একটি গোলাপ দিয়ে বলে, নে এটা নে।  একটা নেব না, সব দ্যান।  তখন পেছন থেকে আরও কয়েক জন এসে জড়ো হয়। চেঁচিয়ে বলে, আমাদেরকেও ফুল দেন।  তোরা সবাই গাছের ফুল নিয়ে আসিসনি কেন?  আপনিতো আমাদের কাছে বটগাছ। আমরা বটগাছ থেকে ফুল নেব।  আশোপাশে হেঁটে যাওয়া দলের কর্মীরা তালি দেয়। বলে, শাবাশ, শাবাশ। মুজিব ভাই ওদেরকে একটি করে গোলাপ দিয়ে দেন। আপনাকে আমাদের আনা বড় ফুলের তোড়া দিচ্ছি।  মুজিব শিশুদের হাতে একটি করে গোলাপ দিলে ওরা দৌড়াতে শুরু করে। বলতে থাকে, আমাদের শহীদরা, আমাদের শহীদরা। ফুলের মালা গলায় পর।  সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বলে, এই শিশুরাও এতকিছু জানে।  মাতৃভাষার জন্য জীবন দানকারী শহীদদের কথা তো ওদের জানতে হবে কবি আপা।  এসব কিছু তোমার অবদান মুজিব। মুজিব দেশবাসীকে নিজেদের ইতিহাস জানিয়ে তৈরি করছ। তোমার রাজনীতি ভিন্ন মাত্রার। তোমার মতো দেশপ্রেমিক হয় না। আমিও তোমার কথায় অনুপ্রাণিত হই। আজকে শিশুদের কাছে এসব শুনে মনে হলো ওরাও তৈরি হচ্ছে। তুমি ওদের প্রাণের মুজিব ভাই।  মুজিব হাসিমুখে মাথা নাড়ে। আর কোনো কথা হয় না। মিছিল বিশ^বিদ্যালয় এলাকা ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। মুজিব ভাবে, সুফিয়া কামালের কারণে আজকের প্রভাত ফেরী অন্য রকম হলো। সুফিয়া কামাল ভাবে, রাজনীতিতে মুজিবের কোনো তুলনা হয় না। তার ত্যাগের কোনো সীমা নেই। তার নিষ্ঠার কোনো পরিসীমা নেই। মানুষের জন্য মমতা আর আত্মার একটা টান আছে। তার মতো একজন মানুষ সারাবিশে^ আমি দেখতে পাচ্ছি না। তার পলায়নী মনোবৃত্তি নেই। যেখানে সংকট, যেখানে সংগ্রাম, যেখানে সংঘাত দেখেছে, সে এসে আগে দাঁড়িয়েছে। মরণকে ভয় করেনি। এসব ভেবে সুফিয়া কামাল ঠিক করে বাড়ি ফিরে এই কথাগুলো লিখে রাখতে হবে। ‘আমার দেখা মুজিব’ নামে আমি একটি লেখা লিখব। আমার এই চিন্তা হারিয়ে যেতে দেব না। যে ছোটরা দৌড়ে এসে ওর পা জড়িয়ে ধরে ওরা এই লেখা পড়লে গভীরভাযে চিনবে মুজিবকে। সামনে আরও সুদিন আছে আমাদের। মুজিবের হাত ধরে সেইসব দিন আমাদের সামনে নতুন দিনের সূচনা করবে।  সবাই শহীদ মিনারের কাছাকাছি এসে যায়। শুনতে পায় একুশের সঙ্গীতআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিআমি কি ভুলিতে পারি সুফিয়া কামাল নিজেও গুনগুন করে গাইতে থাকে।  আপা আসেন একসঙ্গে গান গাই। এই তোমরা সবাই আমাদের সঙ্গে গাও। শুরু হয় একুশের গান। গান শেষে ফুলের বড় তোড়া সামনে নিয়ে মুজিব বলে, আপা ধরেন। আমি আর আপনি এক সঙ্গে ফুল দেব।  দুজনে ফুল নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে শহীদ মিনারের সামনে রাখে। দলের কর্মীরা সেøাগান দিতে থাকে একুশের স্মৃতি অমর হোক একুশের শহীদদের লাল সালাম।  দুজনে নেমে আসে শহীদ মিনারের উপর থেকে।  আপা, আপনাকে একটা রিকশায় তুলে দেই।  হ্যাঁ, দাও। আমি চলে যাই। তুমিতো থাকবে।  হ্যাঁ, আমি থাকব।  আমি একা একা এই শহরে হাঁটব না। মিছিল হলে আমার সাহস বাড়ে। শহীদ মিনারে আমি সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একজন সাহসী মানুষ হয়ে যাই।  এজন্যই তো আপনি কবি আপাগো। আজকে বিকালে আপনি আমার বাড়িতে আসবেন। রেণু আপনার কথা খুব বলে।  আমি জানি রেণু আমাকে খুব ভালোবাসে। ওর মতো মেয়ে হয় না। এত শান্ত, ধীর, স্থির।  আমাদের জন্য দোয়া করবেন আপা।  তুমি বিকালে আমার বাসায় এসো। পিঠা খাওয়াব।  আশপাশের ছেলেমেয়েরা হাসতে হাসতে বলে, মুজিব হাত তুলে ওদের কথা থামায়। রিকশাওয়ালাকে বলে, এ্যাই যাও, এগোও। ঠিকঠাক মতো আপাকে বাড়ি পৌঁছে দিও।  তুমি আসবে না বিকালে?  এখন কিছু বলতে পারছি না। সামনে অনেক কাজ। কখন বাড়ি ফিরব জানি না।  আচ্ছা, যাই। সময় পেলে এসো। না আসলে বুঝব সময় পাওনি।  রিকশা চলে যায়।  মুজিব শহীদ মিনারের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের পার্টির তরফ থেকে ফুল দেয়া হয়। ছোট ছোট ছেলেরা দৌড় দিয়ে উঠে যায় উপরে। ফুল দিয়ে নেমে আসে। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।  মুজিবের হাত ধরে বলে, আজকে আমাদের বাড়িতে যেতে হবে।  এই ভাগ তোরা।  দলের ছেলেরা ওদের তাড়া দেয়। না, আমরা ভাগব না। আমরা মুজিব ভাইকে নিয়ে যাব।  মুজিব ভাই তোদের বস্তিতে যাবে না।  তাহলে আমরা কোথায় থাকব? আমাদেরকে কে দালানে রাখবে?  মুজিব দলের ছেলেদের ধমক দিয়ে বলে, এই তোরা থাম। বস্তিতে ছেয়ে আছে ঢাকা শহর। ওদের জন্য কি তোরা দালান বানাতে পারবি? শুধু শুধু ওদের মন খারাপ করে দিচ্ছিস কেন? এই তোরা ওই পাশে গিয়ে দাঁড়া। আমি যাব তোদের সঙ্গে।  হুররে। মুজিব ভাই, মুজিব ভাই।  ছেলেরা দৌড়ে শহীদ মিনারের এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুলের বিতান থেকে একটা একটা ফুল ছিঁড়ে হাতে নেয়।  মুজিব মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কথা বলেন। রাজনীতির নানা দিক বিভিন্ন সূত্রে কথায় আসে। এক পর্যায়ে ভাসানী বলেন, তোমার নেতৃত্ব বাঙালির সামনে ফুটে উঠেছে মুজিব। যেখানেই যাই অনেকেই তোমার কথা বলে। সাধারণ মানুষের মাঝে তোমার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। মুজিব বলে, আমি ঠিক করেছি আমি স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলব। আমাদের পূর্ববঙ্গকে শোষণ করা ওদের চলবে না। বাঙালির সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের পাট বিক্রি করে পুরো অর্থ ওরা নিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে লাগাচ্ছে। যথেষ্ট করেছে। আর মানব না। ভালোই বলেছ। শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে শপথ নেওয়া হলো। আজকে যাই। আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে।  হ্যাঁ হবে, অবশ্যই হবে।  হাসিমুখে চলে যান মওলানা ভাসানী। শহীদ মিনার থেকে লোকজন চলে যাচ্ছে। ফুল দেওয়ার পর্ব শেষ। বেলা বেড়েছে। চার দিকে রোদ ঝকঝক করছে। মুজিব শিশুদের দিকে এগিয়ে যান। ওরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। হাতের ফুলগুলো তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের তো ফুল কিনার টাকা নেই। এই ফুল কয়টা আপনার জন্য রেখেছি। আপনি বসেন আমরা আপনাকে ফুল দেব।  বসতে হবে না আমার হাতে দে।  সিরাজ বলে, না বসতে হবে। বসলে আমরা মাথায় দিব। ফুল দিয়ে মাথা ভরে দেব।  বাব্বা তোরা এতকিছু ভেবেছিস।  বসেন, বসেন মুজিব ভাই। রব হাততালি দিতে থাকে। চার পাশের নেতা-কর্মীরা হাসতে থাকে।  ঠিক আছে তোদের অনুরোধ রাখছি।  মুজিব বসেন। ছেলেরা চার দিকে দাঁড়িয়ে মাথায় ফুল রেখে দেয়।  আমি দাঁড়ালে তো ফুলগুলো পড়ে যাবে। তখন কি করবি তোরা? আমরা সব ফুল তুলে নেব। বাড়ি নিয়ে যাব। আমাদের মায়েদেরকে ফুল দিয়ে বলব আপনাকে ফুল দিতে। মায়েদের  তো ফুল কিনার টাকা নেই।  এদের তো অনেক বুদ্ধি।  মুজিব হাসতে হাসতে উঠে পড়েন। জসীম বলে, আমরা একদিন বস্তির ঘর ফুল দিয়ে সাজাব। মাকে বলব, খিচুড়ি আর চিংড়ি মাছরান্না করতে। আপনি খাবেন তো মুজিব ভাই?  আমি তোদেরকে খাইয়ে দেব। তোদের পেট পুরো ঢোল হয়ে যাবে।  ঠিক, ঠিক। আমরা সবাই ঢোল হব। মুজিব ভাইয়ের মিটিংয়ে আমরা সবাই ঢোল বাজাব।  মুজিব হাসতে হাসতে বলেন, ছেলেগুলো খুব উচ্ছ্বল।  মুজিব ভাই চলেন বাবুপুরা বস্তিতে।  আমি কিন্তু একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসব। আমাকে বসতে বলবি না তোরা।  আমাদের ঘরে তো চেয়ার নেই। আমরাতো বসতে দিতে পারব না।  আমি বসব না, আমার সময় নেই। তাড়াতাড়ি চল।  সিরাজ ফুলগুলো নান্টুকে দিয়ে বলে, তুই ফুলগুলো নিয়ে দৌড় দিয়ে চলে যা। মায়েদের বলবি ফুলহাতে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। মুজিব ভাইয়ের দুই হাত ভরে মায়েরা ফুল দেবে।  মুজিব হাঁটতে শুরু করলে দলের কর্মীরাও পিছু নেয়। ওরা বলে, আমরা ভেতরে ঢুকব না। রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। মুজিব ভাইকে নিয়ে ফিরব।  ছুটে আসছে ট্রেন। কর্মীরা পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুজিব ছোটদের সঙ্গে বস্তিতে ঢোকেন। ছেলেরা তাঁকে ঘিরে নৃত্যের ভঙ্গিতে এগোচ্ছে। মুজিব দূর থেকে দেখতে পান কয়েক জননারী ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এগিয়ে গেলে নারীরা ফুলগুলো তাঁর হাতে না দিয়ে পায়ের কাছে রাখেন। তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।  মুজিব মাথার ওপর হাত রেখে বলেন, উঠেন মায়েরা। ছোটরা ফুলগুলো হাতে তুলে নেয়। বলে, এগুলো শহীদ মিনারের ফুল।  ঠিক বলেছিস সোনারা। তোদেরকে দোয়া করি। তোরা ভালো থাকিস।  একজন মা বলে, আপনার জন্য এই মোড়াটা রেখেছি। এখানে একটু বসেন।  না, আমি আর বসব না। আমি যাই।  আপনার জন্য কয়েকটা পিঠা রেখেছি। খাবেন না?  আজকে আমাকে সুফিয়া কামাল আপা পিঠা খাওয়াবেন। এই পিঠাগুলো আপনারা খান। ছেলেদেরকে খেতে দেন।  চার পাশে নারী-পুরুষের ভিড় জমে গেছে। সবাই মিলে স্লোগান দিচ্ছেমুজিব ভাই, মুজিব ভাই। জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।  বাবুপুরা বস্তির মানুষেরা চারদিক থেকে ছুটে আসে। সেøাগান থেমে যায়। বয়সী মানুষেরা বলে, মুজিব ভাই আপনি আমাদের জন্য বক্তৃতা করেন। আপনার বক্তৃতা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।  আপনারা জানেন আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি।  হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা জানি আজকে শহীদ দিবস।  তাহলে চলেন সবাই মিলে সেøাগান দেই। মুজিব হাত তুলে বলেন, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না শহীদ দিবস অমর হোক।  বস্তি জুড়ে স্লোগানের ঢেউ বয়ে যায়। নারী-পুরুষ-শিশুদের কন্ঠে স্লোগানের শব্দ বাবুপরা বস্তি ছাড়িয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের এলাকার দিকে ছড়িয়ে যায়। মুজিব হাত নেড়ে হাঁটতে শুরু করলে সবাই স্লোগান দিতে দিতে পেছনে আসে।  নীলক্ষেতের কাছে এলে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়। ওদের স্লোগান থামলে বলে, এবার আপনারা এই স্লোগান দেন।  বলেন, বলেন। নতুন স্লোগান বলেন। [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশছেলেরা সমবেত কন্ঠে স্লোগান দেয়, শেখ মুজিব এসেছেবাঙালি জেগেছে। সমবেত কন্ঠে ধ্বনিত হয় সেøাগান শেখ মুজিব এসেছেবাঙালি জেগেছে। মুখর হয়ে ওঠে এলাকা। চারদিক থেকে বেরিয়ে আসে অনেক মানুষ। সবাই মিলে সেøাগান দিতে থাকে। 

বাংলার মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা

বাংলার মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা

হে ঘুমন্ত পিতা, চিরনিদ্রায় তুমি এখন কেমন আছো? অজানা দেশে পাথর চোখে কি স্বপ্ন দেখ? তুমি কি এখনো ধানসিঁড়ির তীরে বেড়াতে আসো? তোমার বজ্রকণ্ঠ আমরা আজো শুনি- পদ্মার তীরে, লাখ মানুষের ভিড়ে, আজো বেঁচে আছো তুমি সবার হৃদয়ে। পিতা, ক্ষমা করো আমায় তোমার স্বপ্নকে আমি ছুঁয়ে দেখতে পারিনি তোমার ছবি বাঁধিয়ে রেখেছি হৃদয়ে  আমি নেতা হতে পারিনি দাঁড়িয়ে থাকি নেতাদের পিছনে দরপত্র ছাড়া, কম্বলবিহীন; অচেনা পাথরের এই শহরে। পিতা, তোমার রূপসী বাংলা এখন নতুন রূপে, তবে, কম্বল চোরেরা এখনো আছে সদর্পে, মুক্তিরা অনেকেই বেঁচে আছে লাজুক চোখে- অস্ত্রসহ যুদ্ধের ট্রেনিং জমা দিয়েছে অনেক আগেই। জিন্না-টুপিওয়ালাদের এখনো পাওয়া যায় মার্কিনীরা এখনো তাদের চালায় অস্ত্রবিহীন আমরা যুদ্ধ করে চলেছি তোমার স্বপ্নের লাল সবুজের জন্য তুমি এসে দেখে যাও, ক্ষুধা নেই এখানে টুপির চেয়ে শস্য এখন অনেক বেশি, অপুষ্ট গ্রামে মেঠোপথ নেই বললেই চলে, চিঠি, টেলিগ্রাম, ডাকপিয়ন আর নেই, বিজলীর আলোতে তোমার রূপসী আলোকিত নদী পারাপারে এখন আমরা ভিক্ষা করি না,  পদ্মা, যমুনা, মেঘনা পাড়ি দেই নিমেষেই, উড়ালসেতুতে দাঁড়িয়ে অন্যরকম অনুভূতি হয়, নিজেকে আর ক্ষুদ্র লাগে না নক্ষত্রের কাছে দুঃখ শুধু তুমি দেখলে না কিছুই। এখন আমি কবিতা লিখি ভালোবাসার তোমার মতো তর্জনী উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় - কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। কি সুন্দর সেই কথা, হৃদয়ে গাঁথা, জয় বাংলা, জয় মুক্তির পিতা, বাংলার মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা।

যে নির্মমতার ইতিহাস মুছবে না কোনোদিন

যে নির্মমতার ইতিহাস মুছবে না কোনোদিন

একটি দেশ, একটি মানচিত্র, একটি ভূ-খণ্ড যার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছিলাম তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অবিসংবাদিত নেতা, তিনি আপোসহীন নেতা। তিনি বাঙালি জাতির-জাতির পিতা, তিনি জাতির জনক, তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয়ের কারিগর। পৃথিবীর ভূ-খ-ে যার নাম ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত।   যাঁর অকুতোভয় সাহস আর সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নেতৃত্বদানের কারণে আমরা পেয়েছিলাম আজকের এই বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ একদিনের ফসল নয়। দীর্ঘ তেইশ বছরের আন্দোলন, সংগ্রামে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ফসল। যাঁর বজ্রকণ্ঠের জ্বালাময়ী অভিভাষণে গর্জে উঠেছিল সংগ্রামী বাঙালি জাতি। যাঁর তেজোঃদীপ্ত বক্তৃতামালা স্বাধীনতান্মুখ বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির মনে চেতনার বীজ বুনে ছিল। যে ভাষণ শুনে পূর্ববঙ্গের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল।  পশ্চিমপাকিস্তানি, শাসন, শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে যিনি পূর্বপাকিস্তানের জনমানুষের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি পশ্চিমপাকিস্তানি নির্যাতন, নিপীড়ন আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অবদান বাঙালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফার ইস্তেহারে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল পূর্ববাংলার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। এই ছয় দফার প্রেক্ষাপটে ১৯৬৯-এর শুরু হয় গণআন্দোলন। যে আন্দোলনে পূর্বপাকিস্তানজুড়ে শুরু হয় গণবিক্ষোভ। গণজোয়ার সৃষ্টি হয় বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে। তাদের এক দফা এক দাবি ছিল পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতার দাবিতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সাড়ে সাতকোটি বাঙালি সোচ্চার কণ্ঠে জেগে উঠেছিল, মিছিল মিটিং, জনসভা আর গণবিক্ষোভে। যার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।  পূর্ববাংলার মানুষের দাবি আর আন্দোলন চলতে চলতে চলে আসে ১৯৭০-এর নির্বাচন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমগ্র পাকিস্তানে নির্বাচনের আয়োজন করে। পাকিস্তান সরকার ভেবেছিল নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের নেতা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে। আর তখন বঙ্গবন্ধুর তর্জন-গর্জন একেবারে থেমে যাবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। পাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিমপাকিস্তানের ভুট্টো-ইয়াহিয়া গং বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা দেবে না বলে তালবাহানা শুরু করেন। অবশেষে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধুভক্ত ফুকিউরা তাদামাসা

বঙ্গবন্ধুভক্ত ফুকিউরা তাদামাসা

পৃথিবী জুড়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু এবং ভক্তের সংখ্যা অগণন। পার্শ্ববর্তী ভারতকে বাদ দিলে আশ্চর্যের বিষয় যে, অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের চেয়ে তাঁর বন্ধু ও ভক্ত জাপানেই ছিলেন বেশি। এবং অবশ্যই তাঁরা সামান্য সাধারণ নাগরিক ছিলেন না। রাজনীতি, শিক্ষা, গবেষণা, জনসেবা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিবৃন্দ বাঙালির উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তাঁর রাজনৈতিক কর্মকা-ের কথা জানতেন, চিনতেন ১৯৪৭ সালের ভারতভাগের পর থেকেই। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে আটক করা হলে জাপানেও তার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রদের একাংশ এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছিলেন।

স্বাধিকার থেকে সাংবিধানিক নান্দনিকতা

স্বাধিকার থেকে সাংবিধানিক নান্দনিকতা

ব্যক্তির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা প্রায় সমার্থক হলেও এই দুটি বোধের ভিতর প্রকরণগত ও প্রায়োগিক পার্থক্য রয়েছে। যাপিতজীবনে বিভিন্ন স্তর সচেতনভাবে অতিক্রম করতে করতে একজন চেতনাজাগার মানুষ নিজে নিজেই এ দুইয়ের দূরত্ব ও নৈকট্য উপলব্ধি করে। স্বাধিকার বলতে প্রাথমিকভাবে বোঝায় নিজের অধিকার। জন্মের পর থেকে একটি পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষ কিছু অধিকার লাভ করে। যেমন-আহার, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সদাচারী সুকৃতি ইত্যাদি। এই অধিকার মূলত দুই রকম। প্রথমত মূর্ত অধিকার ও দ্বিতীয়ত বিমূর্ত অধিকার। মূর্ত ও বিমূর্ত এই দুই ধরনের অধিকার ব্যক্তি যদি শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার ধাপে ধাপে পেয়ে যায়, তাহলে মানুষ হিসেবে তার বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলো সুষম হতে থাকে। কিন্তু যদি শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণের পূর্ব পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিমানুষ একটি সমাজে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তার মধ্যে অন্তত দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়।

বঙ্গমাতা জাতির পিতার নেপথ্য নির্ভরতা

বঙ্গমাতা জাতির পিতার নেপথ্য নির্ভরতা

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যগণও তাই মনে করতেন। নেতাকর্মীদের বিপদ-আপদে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেওয়ার ব্যতিক্রমী যে ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ছিল, সেই চেতনার আলোয় আলোকিত ছিলেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯৪তম শুভ জন্মদিনে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। জাতির পিতার নাম স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী পরম শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী। আমৃত্যু নেপথ্যে থেকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুকে আগলে রেখেছিলেন এই মহীয়সী নারী। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোতে জাতির জনককে বাস্তবোচিত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দিয়ে তিনি বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে পরমাকাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ায় অনন্য ও ঐতিহাসিক অবদান রেখেছিলেন তিনি।

অবিনাশী জননী তুমি  ফজিলাতুন নেছা

অবিনাশী জননী তুমি ফজিলাতুন নেছা

ধৈর্য, নিষ্ঠা, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণতাÑ অকৃত্রিম এই চার গুণের সংমিশ্রণ ছিলেন বাঙালির অবিনাশী জননী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু নিজেও বলেছেন, আমার জীবনে বৃহৎ অবলম্বন দুটি। এক. আমার আত্মবিশ্বাস, দুই. আমার স্ত্রী, আমার আকৈশোর গৃহিণী। বঙ্গবন্ধু যদি বাঙালির বটবৃক্ষ হয়ে থাকে; তবে বঙ্গমাতা হলেন সেই গাছ যেটি বটবৃক্ষকে ছায়া দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যদি সম্মুখ সমরের সর্বাধিনায়ক হন, তবে বঙ্গমাতা হলেন সেই নায়কের হাতের মশাল; যেটি অন্ধকার পথে আলো ছড়িয়েছিল। তিনি সাধারণে অসাধারণ, চিরায়তে চিরন্তন। তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা এড়িয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস লেখার সুযোগ নেই।