
বাবা শব্দ যেন সাহিত্য-সমগ্র। পৃথিবীর সমস্ত জ্বালা, যন্ত্রণা এবং দুঃখ বুকে চাপা দিয়ে রেখে সন্তানকে আগলে রাখে তিনিই বাবা। বাবাকে নিয়ে হাজারো স্মৃতি চোখের পাতায় পাতায়। কোনটা রেখে কোনটা লেখি। তবে বাবা দিবসে বাবার প্রতি গুরুত্ব ও দায়িত্বশীল আচরণ একান্ত কাম্য। প্রতিটি মানুষের শৈশবের স্মৃতি যেন উজ্জ্বল ছবি। তেমনি ঘটনা আমার জীবনে। আমার বাড়ির পাশেই বাজার। সারাদিন মাঠে কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে বাবা বাজারে যায়। আমিও বাবার ভাঙা সাইকেল চড়ে যাইতাম। বৃষ্টি-বাদলের দিন কাঁচা রাস্তা কাদায় ভরে যেত। তখন বাবা কাদার মধ্যে হেঁটে যেত আর আমাকে সাইকেলের পেছনের সিটে বসিয়ে রেখে কাদা রাস্তা পার করতো। তখন দেখতাম রাস্তার মধ্যে অনেকেই বাবাকে কমরেড বলে ডাকত।
কমরেড শব্দ আমার কাছে মনে হত, যার দাম কম তাকে বুঝি কমরেড বলে। ফলে বাবাকে কেউ যদি কমরেড বলে ডাকে, তখনই আমার বিরক্ত লাগত। তবে একদিন রাগ চেপে ধরে রাখতে না পেরে বাবাকে প্রশ্ন করলাম। আচ্ছা বাবা, মানুষ তোমাকে কমরেড বলে ডাকে কেন? তখন বাবা উত্তরে বললেন, 'কমরেড মানে বন্ধু।' তখন বুঝলাম, গ্রামে বাবার মূল্যায়ন কম কিংবা বেশির বিষয় নয়। বাবা গ্রামের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের বন্ধু।
কৃষকের কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে গ্রামে গ্রামে হাটবাজারে আন্দোলন গড়ে তুলেন। কখনও লাল পতাকা নিয়ে কৃষক, শ্রমিক ও নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ে রাজপথে মিছিল করেন। বামপন্থী রাজনীতি করার কারণে বাবাকে মানুষ কমরেড বলে ডাকত।
শৈশবের স্মৃতি যেন হারিকেনের আলোর মতো। একদিন সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ার রুমে যাচ্ছি। আমি বয়সে তখন ছিলাম কিশোর। আমাদের গ্রাম ছিল না বিদ্যুৎ। রাত হলে পুরো গ্রাম ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে যায়। গণিত বইয়ের বীজগণিতের অঙ্ক করার পর এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই হারিকেনের আলো নিভে যায়। এর মধ্যে পেটে ক্ষুধা লাগছে। তাই রান্নাঘরে গেলাম। মা রান্না করছে। চুলার আগুনে মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মাকে বললাম, ক্ষুধা লাগছে, পড়তে ইচ্ছে করতেছে না। তখন মা বলল, বই ধরে বসলে তোর তো ক্ষুধা লাগে!
তখন মাকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা মা বলতো, বাবা প্রায় প্রত্যেক হাটের কয়েকজন মানুষ সাথে নিয়ে মিছিল করে কেন? অনেকক্ষণ পর মা রেগে গিয়ে বলে, 'তোর বাবা কেন মিছিল-মিটিং করে তা তোর বাবা ভালো জানে। আমি জানি না।' মা বললেন তিনি কিছু জানেন না। তবে আবার বলতে শুরু করলেন, যেই দল কোনো দিন ক্ষমতায় যেতে পারবে না, সেই দল করে সংসার নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হবে না। মায়ের রাগান্বিত মাথায় আমার প্রশ্নের উত্তর জানা হল না। সেই রাতে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন বৃহস্পতিবার হাফ স্কুল। স্কুল ছুটি শেষে বাড়িতে এসে দেখি বাবা গাছের ছায়ার নিচে বসে আছেন। আমার বই, খাতা টেবিলে রেখে স্কুলের পোশাক পরিবর্তন করে, বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। তারপর দেখলাম বাবা কমিউনিস্ট ইস্তেহার নামক একটা বই পড়তেছেন। প্রশ্ন করলাম, বাবা, এই বই কেন পড়? আর কমিউনিস্ট বইগুলোর মধ্যে কী আছে? বাবা এক কথায় উত্তর দিলেন, রাজনীতি করতে হলে এগুলো পড়তে হয়। বাবার ঘরের মধ্যে মার্কসবাদ, ছোটদের রাজনীতি ও অর্থনীতি, মানব সৃষ্টির ইতিহাসসহ বিভিন্ন ধরনের বই রেখেছেন।
আমাদের বাড়ির একমাত্র পরিশ্রমী ব্যক্তি হলো আমার দাদি জমিনা বেগম। তিনি সব সময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকেন। আর বাবা বলতে গেলে সংসারের কোনো কাজই করতেন না। তাই দাদি বাবার বই পড়া পছন্দ করতেন না। দাদি একদিন আমাকে বললেন, দেখ, তোমার বাবা স্কুলের বাচ্চার মত বই পড়ে। তোমার বাবা বুঝি স্কুলে আবার ভর্তি হবে।
প্রায় আধা বুড়া বয়সী একজন লোক এভাবে কী বই পড়ে? সংসারের আয়-রোজগার নিয়ে কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকবে, তা না করে আমার ছেলে বইপড়ুয়া হয়ে গেছে। যে বয়সে পড়ার কথা, সে বয়সে তো পড়ার নামগন্ধ নেই। তবে যাই হোক, দাদি জানতেন না বাবা কেন বই পড়েন।
বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের মুখোশ জানতে হলে বই পড়া আর আন্দোলন ছাড়া মুক্তির পথ নেই। আর রাজপথে মানুষকে জাগ্রত করতে হয়, তাত্ত্বিক বিষয় ভালোভাবে আয়ত্ত করে শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হয়। ফলে বাবা কথায় কথায় বলত, কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না। তিনি আরও বলতেন, কৃষি বাঁচলে বাঁচবে দেশ।
অন্যদিকে বাবা রাজনীতি করুক, মা তা কখনও চায় না। যার কারণে মা ক্ষোভ আর রেগে এক সময় বাবার সংসার ছেড়ে নানার বাড়িতে চলে যাবে প্রায় হুমকি দিত। কিন্তু সন্তানদের রেখে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া তো মুখের কথা নয়। আর বাবা তো বাবার মতই পড়াশোনা আর সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত। বাবা আমাকে শিখিয়েছে, মানুষ জন্মগ্রহণ করলে মানুষ হয় না। তাকে শিক্ষা অর্জন করেই মানুষ হতে হয়।
তিনি প্রায় বলতেন, রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়, রাজনীতি মানে জনগণের নীতি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করা, অর্থাৎ দেশপ্রেমের বীজবপণ শৈশবে ভাসাভাসা ভাবে তৈরি হয়েছে। ফলে যা অজান্তেই আমার মনের মধ্যে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ভালোবাসার জাল তৈরি হয়েছে, বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে।
বাবা আমাকে শ্রেণি বৈষম্য আর শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি সংগ্রামের শিক্ষা দিয়েছেন। বাবার মুখের ভাষাগুলো আমার জীবনে প্রত্যেকটি স্লোগান হিসেবে থাকবে। যিনি সৃষ্টি করেন তিনি মহান। বাবা আমার কাছে মহান। স্মৃতি দেয় জ্ঞান, স্মৃতি আনে মুক্তি। জীবনের স্মৃতিগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে মুক্তির পথ খুঁজি। বাবা কোনো প্রতিদানের জন্য ভালোবাসেন না। তিনি ভালোবাসেন আত্মার টানে, ভালোবাসার স্নেহের আবেশে, ভালোবাসেন কর্তব্যের চেয়ে অধিকারের পরশে। তাই প্রত্যেক সন্তানের উচিত বাবার মতই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে বাবাকে সুস্থ রাখা।
বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় শ্রদ্ধাবোধ ও মূল্যবোধের বড় অভাব। বৃদ্ধ বাবার প্রতি যে আচরণ করা হয়, তা দেখে নিমিষেই চোখে জল আসে। তবে বাবা দিবসে পিতার ছবি ফেসবুকে ভালোবাসার কমতি নাই। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফেসবুকের ভালোবাসা নয়, বাস্তবে ভালোবাসতে হবে। বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে নয়, নিজের বুকে আগলে রাখতে হবে। শেষ বয়সে বৃদ্ধ পিতামাতাকে যে সকল সন্তান ভরণপোষণ দেবে না এবং সামাজিকভাবে নানা কৌশলে নির্যাতন করবে, তাদের প্রত্যেকে আইন আওতায় এনে রাষ্ট্রের উচিত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
বিশেষ করে খেটে-খাওয়া দিনমজুর বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে নিদারুণ নিষ্ঠুর কষ্টে দিনাতিপাত করে। চিকিৎসার খরচ পায় না। টাকার অভাবে তিন বেলা ঠিকঠাক মতো খাবার পায় না। তখন স্বাভাবিকভাবে মনে হয়, উপকারী গাছের ছাল থাকে না, সেই উপকারী গাছ হলো বাবা। এমন অসহায় মানুষের তালিকা সঠিকভাবে তৈরি করে রাষ্ট্রের উচিত তাদের সহযোগিতা করা, কারণ যুবক বয়সে শ্রম দিয়ে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছিল, তা ভুলে গেলে চলবে না।
আফরোজা