
আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় বড় হয়ে তাকে চাকরির পিছনেই দৌড়াতে হবে। চাকরিই তাদের একমাত্র পথ। কিংবা চাকরি যদি না করে তাহলে তারা যেন জীবনযুদ্ধে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল- এমন এক ধারণা তাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এমন সব ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়ার কারণে সিংহভাগ তরুণ-তরুণী আজ চাকরির বাজারের দিকে ছুটছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন চাকরির পিছনে ছুটতে ছুটতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে গেলে জুতা ছাড়া খালি পায়ে হলেও চাকরির পিছনেই দৌড়াতে হবে। তবুও নিজে কোনো ব্যবসা দাঁড় করানোর ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে না। এমন ধারণার জন্যই দেশের চাকরি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণ-তরুণীদের জুতার তলা ক্ষয় করার একটি বড় ধরনের সুযোগ পেয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের বেকারত্বের হারের দিকে নজর দিলেই আমরা বুঝতে পারব চাকরির বাজারের অবস্থা এবং তরুণদের বেকারত্বের মূল কারণ কি।
চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের বেকারত্বের হার বেড়ে ৪.৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। ১৮ মে ২০২৫ (রবিবার) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের মাধ্যমে এ তথ্য পাওয়া যায়। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর শেষে ১৯তম আইসিএলএস (ওহঃবমৎধঃবফ ঈবহংঁং ধহফ খধনড়ঁৎ ঋড়ৎপব ঝঁৎাবু) অনুযায়ী দেশের বেকার জনগোষ্ঠী বেড়ে ২৭ লাখ ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ২৪ লাখ। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজা। এক বছরে বেকারত্বের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেত না যদি দেশের সন্তানরা আত্মনির্ভরর্শীল কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা চালাতো। এই সকলের একত্রে চাকরিমুখী হওয়াটা যেমন বেকারত্বের একটি মূল কারণ ঠিক তেমনই আরও কিছু কারণ আছে। যেমন- কারিগরি ও ব্যবহারিক দক্ষতায় ঘাটতি। আমাদের দেশে এমন একটা অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে, যেখানে শুধু পরীক্ষায় খাতায় লেখার জন্য শিক্ষার্থীরা মুখস্থের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যে যত বেশি মুখস্থ করতে পারবে সে ততো বেশি নম্বরে এগিয়ে থাকতে পারবে- বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা যেন শুধু সার্টিফিকেটনির্ভর হয়ে উঠেছে। সার্টিফিকেটের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় স্কিল অথবা কারিগরি শিক্ষার দিকে ঝুঁকে না। কিংবা তাদেরকে সে সব বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে না। বরং পুরোপুরি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে মুখস্থ বিদ্যা এবং সার্টিফিকেটের দিকে। যা ভবিষ্যতে খুব একটা কাজে আসবে না তা প্রায় নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বাইরের দেশগুলোর ন্যায় স্কুল-কলেজ থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সময়ে। মাইক্রোসফট অফিস (ডড়ৎফ, ঊীপবষ, চড়বিৎচড়রহঃ), ইমেইল লেখা ও প্রফেশনাল ব্যবহার, অনলাইন রিসার্চসহ আরও অনেক ব্যবহার শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এসব বিষয় যখন স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেখানো হয় না; তখন চাকরি জীবনে বেশ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। অন্যদিকে, আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয় শুধু কাগজে-কলমে, যা ভবিষ্যতের জন্য মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। এখনো অধিকাংশ স্কুল-কলেজে ‘পাবিলিক স্পিকিং’ সম্পর্কে কোনোরকম ধারণা বা শিক্ষা দেওয়া হয় না, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমেও যেমন এক ধরনের দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয় ঠিক তেমনিভাবে বক্তৃতা-দক্ষতার বিকাশ ঘটে নিজের মধ্যে। এসব পড়ালেখার বাইরে এক অনন্য দক্ষতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এখনো আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব বিষয়ের ওপর কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
যদি দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে এসব বিষয়ে শেখানো হতো এবং তাদের পারদর্শী করে গড়ে তুলতে পারতো তাহলে হয়তো চাকরির বাজারে এতো ধকল পোহাতে হতো না এবং একইভাবে বেকারত্বের হার হ্রাস পেতো। যদি একজন শিক্ষার্থীকে জিরো লেভেল থেকেই ডিজিটাল এবং কমিউনিকেশন স্কিল সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা দেওয়া হয় তাহলে অনেকেই চাকরির পিছনে ঘুরে জুতা ক্ষয় না করে নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপারে মগ্ন থাকবে এবং সেভাবেই নিজেকে গড়ে তোলার যথাযথ চেষ্টা করবে।
দেশের বর্তমান সরকারের নিকট অনুরোধ করবো দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু খাতা-কলমের শিক্ষা নয় বরং এর থেকে বের হয়ে এসে যেন ডিজিটাল ও কমিউনিকেশন স্কিলের প্রতি জোর নজর দেয়। তবেই আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার উপযোগী হয়ে উঠবে। এতে করে একজন ব্যক্তির শিক্ষার গুণগতমান বাড়বে। সেই সঙ্গে অনেকাংশে হ্রাস পাবে বেকারত্ব এবং দেশ অগ্রগতির দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
প্যানেল