
ছবি: প্রতীকী
প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার মুহূর্ত থেকে শুরু করে দিনের প্রথম কফির চুমুক পর্যন্ত আমরা প্রায় সবাই কোনও না কোনও প্রযুক্তি ব্যবহার করি। এক সময় সকালে ঘুম ভাঙানোর দায়িত্বে থাকত মা-বাবা কিংবা একটি ময়ূরপঙ্খী ঘড়ি। এখন সে জায়গায় জায়গা নিয়েছে স্মার্টফোনের অ্যালার্ম। প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের দিনের শুরু এভাবেই।
বিছানা থেকে উঠেই অনেকে প্রথমে যে কাজটি করেন, তা হলো মোবাইল ফোন হাতে নেওয়া। কেউ চেক করেন রাতভর মিস হওয়া মেসেজ, কেউ খোঁজ নেন আজকের আবহাওয়া কেমন, আবার কেউ সংবাদ পড়েন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ক্রল করেন। এই অভ্যাসটি অনেকের কাছে এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে প্রযুক্তি ছাড়া সকালটা যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়।
সকালে প্রযুক্তি ব্যবহারের আরেকটি সাধারণ দিক হলো সংবাদ পাঠ। আগে মানুষ পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করত, এখন মোবাইলে বিভিন্ন নিউজ অ্যাপ বা ওয়েবসাইট খুললেই চোখের সামনে এসে যায় দেশ-বিদেশের সমস্ত খবর। এই প্রযুক্তি নির্ভরতা যেমন সময় বাঁচায়, তেমনই তা আমাদের বাস্তবিক জগত থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কারণ, কখনো কখনো সংবাদ পড়তে গিয়ে কিংবা ইউটিউব বা ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে সকালের এক ঘণ্টাও কেটে যায়, অথচ নিজের শরীর বা মনকে প্রস্তুত করার মতো কিছু করা হয় না।
অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীরচর্চা করেন—কিন্তু সেটিও আজকাল প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া যেন সম্ভব নয়। কেউ ইউটিউব ভিডিও দেখে যোগব্যায়াম করেন, কেউ ফিটনেস অ্যাপ ব্যবহার করে ওয়ার্কআউট ট্র্যাক করেন, আবার কেউ স্মার্টওয়াচ দিয়ে হার্ট রেট থেকে শুরু করে ক্যালরি বার্নের হিসাব রাখেন। প্রযুক্তি আমাদের ব্যায়ামকে আরও নিয়ন্ত্রিত ও ফলপ্রসূ করে তুলেছে ঠিকই, তবে কখনো কখনো এটির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের প্রকৃত অনুভূতি বা শরীরের সংকেত বোঝার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
অনেকেরই সকালের প্রযুক্তি ব্যবহারের তালিকায় থাকে মিউজিক বা পডকাস্ট। অনেকেই ঘুম থেকে উঠে ইয়ারফোন কানে দিয়ে পছন্দের গান বা অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তা শোনেন। এটি একদিকে আমাদের মনকে সতেজ করে, অন্যদিকে দিনের শুরুর মানসিক প্রস্তুতিতে সহায়ক হতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই অভ্যাস কি আত্ম-মননকে বাড়াচ্ছে, না কি একধরনের অটোমেটিক রিফ্লেক্সে পরিণত হচ্ছে যেখানে নিজের সঙ্গে নিজের সময় কাটানো হচ্ছে না?
অফিসগামীদের জন্য প্রযুক্তি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক—মেইল চেক করা, ক্যালেন্ডার দেখা, দিনের কাজের তালিকা তৈরি করা কিংবা জরুরি মিটিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া। অনেকেই ঘুম থেকে উঠেই অফিসের মেইল চেক করে ফেলে, এমনকি সকালের নাশতা খেতে খেতেও ফোনে চোখ রাখেন। এতে করে দিনের কাজ শুরু হওয়ার আগেই এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। অফিসের সময়ের আগেই কাজে ঢুকে যাওয়ার এই প্রবণতা কর্মজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের সীমারেখা ঝাপসা করে তোলে।
শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। অনেকেই সকালে ঘুম থেকে উঠে অনলাইন ক্লাসের প্রস্তুতি নেয়, কেউ নোট পড়ে, আবার কেউ টিউটোরিয়াল দেখে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ এখন পড়াশোনার অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও একটা বড় সমস্যা হলো—পাঠ্যবিষয়ক কনটেন্টের ফাঁকে ফাঁকে অন্যান্য অ্যাপের নোটিফিকেশন মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে যায়।
সকালের প্রযুক্তি ব্যবহারে ইতিবাচক অনেক দিক থাকলেও কিছু নেতিবাচক দিকও উপেক্ষা করা যায় না। একটানা স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখের ওপর চাপ পড়ে, মাথাব্যথা হয়, এবং সারাদিন ক্লান্তিভাব বিরাজ করে। প্রযুক্তি ব্যবহারকে যদি নিয়ন্ত্রিত রাখা না যায়, তবে তা দিনের শুরুতেই মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
অতএব, প্রশ্ন ওঠে—প্রতিদিন সকালে প্রযুক্তির সঙ্গে কতটা সময় কাটানো উচিত? এর উত্তর নির্ভর করে ব্যক্তিভেদে। কারও প্রযুক্তি ব্যবহারে দিনের শুরু হয় ইতিবাচক ও কার্যকরভাবে, আবার কারও ক্ষেত্রে তা সময় অপচয় ও উদ্বেগের কারণ হয়। মূল বিষয়টি হলো সচেতনতা। আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করব—তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু প্রযুক্তিই যদি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করে, তাহলে সমস্যার শুরু সেখানেই।
সকালের সময়টুকু আমাদের সারা দিনের গতিপথ নির্ধারণ করে। তাই এই সময়টা যতটা সম্ভব ভারসাম্যপূর্ণ ও মননশীলভাবে কাটানো জরুরি। প্রযুক্তি হোক আমাদের সহায়ক, নিয়ন্ত্রক নয়। সকালের প্রথম ঘণ্টাটি যদি প্রযুক্তির ওপর কম নির্ভর করে, নিজের ভেতরের ভাবনা, শরীর ও মনকে বুঝে কাটানো যায়—তবে হয়তো সারা দিনটাই আরও সুস্থ ও প্রেরণামূলক হতে পারে।
প্রতিদিন সকালে প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেকটাই দ্বিমুখী। এটি যেমন আমাদের কাজে গতি আনে ও যুক্ত করে বিশ্বের সঙ্গে, তেমনি এটিই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় নিজের কাছ থেকে, যদি না আমরা সচেতনভাবে তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করি। প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের এই সম্পর্কটুকু যতটা সংবেদনশীল ও সচেতন হবে, ততটাই তা আমাদের কল্যাণে কাজে লাগবে।
এম.কে.