
ছবি: প্রতীকী
ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম যে জিনিসটির দিকে আমাদের দৃষ্টি যায়, তা হলো স্মার্টফোন। অনেকেই হয়তো চোখ পুরোপুরি না খোলার আগেই ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রল শুরু করে দেন। কিন্তু এই নিরীহ অভ্যাসটি এখন এক ভয়াবহ বিপদের রূপ নিচ্ছে—কারণ, সকালবেলা ফোন হাতে নিয়েই অসাবধানতাবশত স্ক্যাম লিংকে ক্লিক করে বসছেন বহু মানুষ। এতে শুধু ব্যক্তিগত তথ্যই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।
বর্তমানে সাইবার অপরাধীরা মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস ও মানসিক দুর্বলতাগুলো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা জানে, মানুষ ঘুম থেকে উঠেই সবচেয়ে বেশি অসতর্ক থাকে। মাথা পুরোপুরি সচল না থাকা, চোখে ঝাপসা ভাব থাকা বা তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকার কারণে আমরা তখন অনেক কিছু যাচাই না করেই ক্লিক করে ফেলি। এই মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটিকে টার্গেট করেই তৈরি করা হচ্ছে চতুর স্ক্যাম লিংক, ভুয়া মেসেজ ও ফিশিং ওয়েবসাইট।
ধরুন, সকালে ঘুম ভাঙার পর আপনি হোয়াটসঅ্যাপ খুললেন। সেখানে দেখলেন, একটি পরিচিত নম্বর থেকে একটি বার্তা এসেছে—“আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫০,০০০ টাকা জমা হয়েছে, বিস্তারিত জানতে এই লিংকে ক্লিক করুন।” বা হয়তো একটি অজানা নম্বর থেকে এসএমএস এল—“আপনার ইন্টারনেট প্যাক শেষ হয়ে গেছে, রিচার্জ করতে এই লিংকে যান।” এই ধরনের মেসেজগুলো সাধারণত আমাদের কৌতূহল, ভয় বা লোভকে উসকে দেয়। আর একবার আপনি ক্লিক করলেই ঘটে যায় সর্বনাশ।
স্ক্যাম লিংকে ক্লিক করা মাত্রই আপনার ফোনে ম্যালওয়্যার বা স্পাইওয়্যার ঢুকে যেতে পারে। এটি আপনার ব্যক্তিগত ডেটা, কনট্যাক্ট লিস্ট, পাসওয়ার্ড, এমনকি ব্যাঙ্ক অ্যাপ থেকে তথ্য চুরি করে নিতে পারে। অনেক সময় স্ক্যামাররা এমন একটি পেজ তৈরি করে যেটি দেখতে হুবহু আপনার ব্যাংকের মতো। আপনি সেখানে গিয়ে আপনার ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড দিলে তারা সরাসরি আপনার একাউন্টে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই টাকা উধাও হয়ে যেতে পারে, আর আপনি টেরও পাবেন না।
এমনকি এখন আর স্ক্যামারদের শুধু ভুয়া লিংক পাঠিয়েই কাজ হয় না। তারা প্রযুক্তির সর্বশেষ সুবিধাগুলো ব্যবহার করে ‘স্মার্ট’ স্ক্যাম তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক স্ক্যাম এখন বাস্তব কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে আসে—যেমন, “বাংলালিংক” বা “বিকাশ”-এর নামে একটি বার্তা যেখানে বলা হয়, “আপনার নাম্বারে একটি পুরস্কার জিতেছেন, পেতে হলে এখনই এই লিংকে যান।” আপনি যদি তখনো পুরোপুরি জেগে না থাকেন, তাহলে অনায়াসেই সে লিংকে ক্লিক করতে পারেন।
আরও বিপজ্জনক হলো সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্যাম। আপনি ফেসবুক খুলে দেখলেন, একজন বন্ধু একটি ভিডিও লিংক পাঠিয়েছেন যার ক্যাপশনে লেখা, “তোমার এই ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গেছে, দেখে নাও।” আপনি না ভেবেই ক্লিক করলেন। কিন্তু কিছুই প্লে হলো না। বরং আপনার প্রোফাইল হ্যাক হয়ে গেল। এরপর আপনার নাম ব্যবহার করে অন্যদের কাছেও সেই স্ক্যাম ছড়িয়ে দেওয়া হলো। ফলে আপনি একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে নিজের পরিচিতদেরও ঝুঁকিতে ফেলছেন।
কীভাবে রক্ষা পাবেন এই ফাঁদ থেকে? প্রথমত, ঘুম থেকে উঠেই ফোন না ধরাই সবচেয়ে ভালো। নিজেকে কয়েক মিনিট সময় দিন, মাথা ঠান্ডা করুন, সতর্ক থাকুন। এরপর ফোন হাতে নিলেও, কোনো লিংক বা বার্তায় ক্লিক করার আগে যাচাই করুন সেটি কোথা থেকে এসেছে। অপরিচিত নম্বর বা সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো বার্তা এলে সেটি একবার গুগল করে দেখুন বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিশ্চিত হন।
দ্বিতীয়ত, ফোনে শক্তিশালী অ্যান্টিভাইরাস ও স্প্যাম ফিল্টার ব্যবহার করুন। আপনার ফোনের অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যাপ্লিকেশনগুলো নিয়মিত আপডেট করে রাখুন, কারণ সাইবার দুর্বলতাগুলোর সমাধান এসব আপডেটেই থাকে। এছাড়া, দুই ধাপ যাচাইকরণ (two-factor authentication) চালু রাখুন, বিশেষ করে ব্যাংকিং অ্যাপ বা ইমেইল অ্যাকাউন্টে।
তৃতীয়ত, পরিবার ও প্রিয়জনদেরও এই বিষয়ে সচেতন করুন। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ বা প্রযুক্তিতে অনভিজ্ঞ ব্যবহারকারীরা এসব স্ক্যামের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন বেশি। তাদের বলুন, কোনো মেসেজ এলেই যেন ক্লিক না করেন, এবং সন্দেহ হলে আগে পরিবারের কাউকে জানান।
শেষ কথা হলো, প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে— এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও মানতে হবে যে প্রযুক্তির অপব্যবহারও বাড়ছে ভয়াবহ গতিতে। সকালের ঝিম ধরা সময়ে আমাদের ক্লিক একটি বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর প্রথম কাজ যেন হয় সতর্কতা, না যে কোনো লিংকে ক্লিক। সচেতন থাকুন, নিরাপদ থাকুন। সাইবার অপরাধীদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করুন একটুখানি বুঝে শুনে চলার মধ্য দিয়ে।
এম.কে.