ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

মাইলস্টোন-স্কুল ট্র্যাজেডি

মানবতার এপিঠ-ওপিঠ

আরিফুল ইসলাম রাফি

প্রকাশিত: ১৯:৪৫, ২৪ জুলাই ২০২৫

মানবতার এপিঠ-ওপিঠ

এক সময়ের চিরচেনা মানবিক মূল্যবোধ আজ ভাঙনের মুখে। সমাজে ন্যায়-নীতি, সহমর্মিতা ও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট স্বার্থ, হিংসা, লোভ আর হানাহানিতে মানুষের মনুষ্যত্ব যেন হারিয়ে ফেলেছে নিজের আসল রূপ।
গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ প্রাঙ্গণে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা শুধু প্রাণহানি ও শোকই নয়, মানুষের নৈতিকতা ও অনৈতিকতারও নগ্ন প্রতিফলন এনে দিয়েছে। এই ঘটনায় আমরা যেমন দেখেছি সহমর্মিতা, বীরত্ব আর মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত; তেমনি দেখেছি লোভ, দায়িত্বহীনতা আর অমানবিকতার অন্ধকার চিত্র। মানবতার উজ্জ্বল মুখ : দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের মানুষ ছুটে আসে ধোঁয়া আর আগুনের ভেতরে। অনেকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহত শিশুদের কোলে তুলে নেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ বিনা স্বার্থে উদ্ধার কাজে অংশ নেন ও উদ্ধারকর্মীদের সাহায্য করেন। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা অবিরত সেবা দিয়ে গেছেন রাতভর। শিক্ষকরা আহতদের পাশে দাঁড়িয়ে অভিভাবকদের খুঁজেছেন। এসব মানুষের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়-মানবিকতা এখনো মরে যায়নি। 
ঢাবি, জাবি, জবি, বুয়েট, ডুয়েটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ও সাধারণ মানুষ রক্তদানে এগিয়ে এসেছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিপুল চাহিদা থাকার পরেও রক্তের বড় কোনো সংকট দেখা যায়নি।
অমানবিকতার অন্ধকার : কিন্তু একই সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে মানুষের নৈতিক সংকটও। দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যেখানে উদ্ধারকারীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল আক্রান্তদের দ্রুত উদ্ধার করতে; সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় বাধাগ্রস্ত করে পুরো উদ্ধার কার্যক্রমকে। মানুষের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে অ্যাম্বুলেন্সগুলো ঠিকমতো চলাচল করতে পারছিল না। এতে উদ্ধার কাজে বেশ বেগ পেতে হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়ানো হয়েছে ‘শতাধিক শিশু নিহত’, ‘পাইলট ইচ্ছাকৃতভাবে মেরেছে’ এরকম শিরোনামে অনেকে ভিউ বাণিজ্য করেছেন। ২০ টাকার রিক্সা ভাড়া ১০০ টাকা কিংবা ৩০ টাকার সিএনজি ভাড়া ১০০০ টাকা চেয়ে বসতেও দ্বিধাবোধ করেনি মানুষ। প্রতি লিটার পানি বিক্রি হয়েছে ২০০-৩০০ টাকায়। আহত ছাত্রছাত্রীরা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য মানুষের সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু কেউ গাড়ি থামাতে রাজি হয়নি। এ যেন মানবতার এক বীভৎস রূপ।
দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের অবহেলাও অনৈতিকতার বড় প্রমাণ। উড্ডয়নের আগে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে কি না সেটি বড় প্রশ্ন। জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমানের মহড়া চালানো- এসবের দায় এড়ানো যাবে না।
আমাদের করণীয় : মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি আমাদের সামনে মানুষের দুটো দিকই স্পষ্ট করে দিয়েছে। আমরা যেন কেবল মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক প্রকাশে থেমে না যাই। দুর্ঘটনার তদন্তে স্বচ্ছতা ও দ্রুততম সময়ে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি গুজব ও সুযোগসন্ধানী মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমাদের সবার- ব্যক্তি পর্যায় থেকে মানবিকতার চর্চা শুরু করা। দুর্ঘটনার সময় ভিড় না করে উদ্ধারকাজে সহায়তা করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাই ছাড়া কিছু না ছড়ানো- এগুলো আমাদের দায়িত্ব। মাইলস্টোনের এই মর্মান্তিক দিন আমাদের শিখিয়েছে- মানবতার এপিঠ যত উজ্জ্বল, তার ওপিঠও ততটাই অন্ধকার। আমরা কোন পথে যাব- তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সামষ্টিক কল্যাণকে প্রাধান্য দিতে হবে। সমাজে ভালো মানুষ এখনো আছে, তাদের সংখ্যা বাড়ানোই আমাদের দায়িত্ব। এই ঘটনার শিক্ষা যেন শুধু স্মৃতির পাতায় না থেকে যায়। আলোকিত দিক বেছে নিয়ে আগামীর প্রজন্মের জন্য একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

 

 

প্যানেল/মো.

×