
বর্ষা মানেই প্রকৃতির প্রশান্তি, নতুন করে জেগে ওঠা সবুজের হাসি, আর ধূলিমাখা শহরের পরিষ্কার হয়ে ওঠা। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষ জানে, বর্ষা মানেই দুর্ভোগ, জলাবদ্ধতা আর ভয়াবহ যানজট। আকাশের মেঘ যতই ভালো লাগুক, বৃষ্টির ফোঁটা মানেই আতঙ্কের শুরু। রাজধানীর প্রতিটি প্রান্তে যেন বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় জনজীবন বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা-যানজট, জনজীবনে ভোগান্তি। অফিসগামী মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসা নিতে বের হওয়া রোগী সবার পথেই একটাই বাধা: পানি আর জ্যাম।
সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, বিকেলে মুষলধারে রূপ নেয়। সড়কে জমে ওঠে পানি, যান চলাচল হয়ে পড়ে ধীর, তারপর পুরোপুরি থেমে যায়। পানি জমে থাকার কারণে বাস থেকে নামতেই হয় হাঁটুপানি মাড়িয়ে। স্কুলছাত্রদের জুতা ভিজে কাদা হয়ে যায়, কেউ কেউ রিক্সায় উঠতে গিয়ে পড়ে যায়, অফিসগামী মানুষদের পোশাকে কাদা লেগে কর্মস্থলে গিয়ে বিব্রত হতে হয়।
ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। নতুন নতুন ভবন গড়ে উঠছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে না সড়ক বা ড্রেনেজ ব্যবস্থা। একদিকে খাল দখল, অন্যদিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় পথগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ময়লা-আবর্জনায়। রাস্তায় ময়লা পড়ে, সেগুলো পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেই। আর যখন বৃষ্টি নামে, তখন সেই আবর্জনার সঙ্গে পানি মিশে তৈরি হয় চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। নাগরিক জীবনে যুক্ত হয় রোগ-জীবাণুর ভয়ও।
বিশ্বের উন্নত শহরগুলোতে বৃষ্টিকে প্রতিকূলতা নয়, সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। টোকিও, লন্ডন কিংবা আমস্টারডামের মতো শহরগুলোতে অত্যাধুনিক নিকাশী ব্যবস্থা, ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক কন্ট্রোল ও পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা থাকার কারণে বৃষ্টি শহরের স্বাভাবিক জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু ঢাকায় একটি মাঝারি বৃষ্টিই শহরজুড়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। অথচ প্রযুক্তি, অর্থ কিংবা জনবল—কোনো কিছুতেই আমরা পিছিয়ে নেই; পিছিয়ে কেবল সদিচ্ছা ও সমন্বিত পরিকল্পনায়।
এই অব্যবস্থার দায় শুধু প্রশাসনের নয়, নাগরিকদেরও। রাস্তায় ময়লা ফেলা, ড্রেনের মুখে আবর্জনা জমতে দেওয়া, উচ্ছেদকৃত খাল আবার দখল হওয়া এসবের পেছনেও আছে আমাদের দায়িত্বহীনতা। প্রশাসনের যেমন দরকার টেকসই নগর পরিকল্পনা, ঠিক তেমনই দরকার নাগরিকদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ।
এখনই সময়, প্রতিটি সড়কে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট সময় পরপর ড্রেন পরিষ্কার, শহরের খালগুলো উদ্ধার, পানি আটকে পড়া এলাকা শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের এই পদক্ষেপগুলো এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং জরুরি চাহিদা।
বৃষ্টি মানেই হোক, দুর্ভোগ নয় এটাই হোক আমাদের শহর পরিকল্পনার মূলমন্ত্র। ঢাকার মানুষ বৃষ্টির সৌন্দর্য দেখতে চায়, দুর্ভোগে ডুবে মরতে নয়। এই শহরের মানুষ আর বৃষ্টিকে ভয় পেতে চায় না। তারা চায় একটি শহর, যেখানে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি আসবে কিন্তু থামাবে না জীবনের গতি। যেখানে জলজট নয়, থাকবে দ্রুত নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা। যেখানে যানজট নয়, থাকবে সুপরিকল্পিত চলাচল ব্যবস্থা। ঢাকাকে একটি আধুনিক, সচল ও বাসযোগ্য শহর বানাতে হলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা চাই এমন এক শহর, যেখানে মানুষ প্রকৃতিকে আপন করে নেয়, উন্নয়নের নামে প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না? সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার, কথার নয়, কাজে দেখানোর।
প্যানেল/মো.