ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

মাইলস্টোন-স্কুল ট্র্যাজেডি

ঘনবসতিপূর্ণ শহরের আকাশে প্রশিক্ষণ বিমান!

প্রজ্ঞা দাস

প্রকাশিত: ১৯:৩৩, ২৪ জুলাই ২০২৫

ঘনবসতিপূর্ণ শহরের আকাশে প্রশিক্ষণ বিমান!

আকাশে প্রশিক্ষণ চালনার মতো গুরুতর বিষয়টি কতোটা দায়িত্বহীনভাবে এবং বিপজ্জনক পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে, তার প্রমাণ পূর্বেই একাধিক দুর্ঘটনার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। তার পরও আমরা সতর্ক হইনি। এ ঘটনাগুলো কেবল দুর্ঘটনা নয়, বরং অবহেলার ফসল, যেগুলো রাষ্ট্রের অদক্ষতা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা চিন্তার অভাবের নগ্ন অবস্থাকে পুরো জাতির সামনে তুলে ধরেছে। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২ কোটির অধিক মানুষের বসবাস এই মহানগরীতে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, আদালত সবকিছু মিলিয়ে এই শহর কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক কেন্দ্রবিন্দু। এমন একটি শহরের ওপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান ওড়ানো মানে হলো দাহ্য পদার্থ পরিপূর্ণ একটি একটি জায়গার ওপর দিয়ে দিনের পর দিন আগুনের ফুলকি ছড়ানো। শহরের ওপর দিয়ে বিমান চলাচলের পরিণতি শুধু শব্দ দূষণেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি জনমানসে ভীতি তৈরি করে, শিশুমনে আতঙ্কের বীজ বপন করে এবং শিক্ষালাভের পরিবেশকে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো তেজগাঁও বিমানবন্দর যখন গড়ে উঠেছিল, তখন কুর্মিটোলা অঞ্চল ছিল এক বিস্তৃত বনজ-নির্জন প্রান্তর। তখন ঢাকার নবাববাড়ি ও অভিজাত শ্রেণির শিকারবিলাসীদের পদচারণায় মুখর এই এলাকা জনমানবহীনই ছিল প্রায়। সেই সময় ঢাকায় উড্ডয়ন ক্লাব স্থাপন ও সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ হয়তো যৌক্তিক ছিল। কিন্তু সময় পাল্টেছে, বদলেছে ঢাকা শহরের চেহারা। এখন কুর্মিটোলার আশপাশে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ভবন, গলিঘুঁজির মধ্য দিয়ে গিজগিজ করছে নগরের শ্রেণিশিক্ষা কেন্দ্রগুলো। সেই বাস্তবতায় এখনো ঢাকার মাঝখানে উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের মতো কর্মকাণ্ডের স্থিতি রাখার সিদ্ধান্ত শুধু অযৌক্তিক নয়, নাগরিক জীবনের ওপর এক নির্মমতা। বাংলাদেশের ভেতরে লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, শমসেরনগর, কুমিল্লা কিংবা ফেনীর মতো এলাকায় বহু পরিত্যক্ত বিমান ঘাঁটি রয়েছে যেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল। এসব রানওয়ে আজও দৃশ্যমান। জনবসতিমুক্ত, অপেক্ষাকৃত খোলামেলা ও প্রশিক্ষণের উপযোগী পরিবেশে এসব অঞ্চলকে উপযুক্ত পরিকল্পনায় আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী যেভাবে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেভাবে বিমানবাহিনীও চরাঞ্চল ভিত্তিক নিরাপদ প্রশিক্ষণ অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারে। এতে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে, জনমানুষের জীবনও থাকবে সুরক্ষিত। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাই, গত এক দশকে বিমানবাহিনীর অভ্যন্তরে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র প্রকট হয়েছে বারংবার। কিন্তু সেগুলোকে কর্ণপাত না করে বরং এই দুর্নীতির চক্রাকার শেকল চলছে আজ পর্যন্ত। বিমান কেনার মতো মূল খাতে খরচ না করে গেট, বাগান, প্রাচীর আর দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পুরানো, জীর্ণ, কর্মক্ষমতাহীন বিমানের মধ্যমেই চালানো হচ্ছে প্রশিক্ষণ। যাকে ‘ফ্লাইং কফিন’ নামে অভিহিত করা হয়। এই ফ্লাইং কফিন উড্ডয়ন মানে শুধু ঝুঁঁকি নয়, একপ্রকার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যেখানে প্রাণের চেয়ে প্রাচীর বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া বিমান চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু নীতিমালা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (ওঈঅঙ) নিয়ম অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল এড়িয়ে নিরাপদ এবং খোলা আকাশ-পরিধি নির্বাচন করা বাধ্যতামূলক। অনেক দেশেই এই নিয়ম কঠোরভাবে মানা হলেও বাংলাদেশে এখনো ঢাকার মতো মহানগরের মধ্যে এমন অনুশীলন চালু থাকা দৃষ্টিকটুভাবে অনিয়মপ্রবণ এবং সাধারণ জনগণের জীবনের প্রতি রাষ্ট্রের এক নির্মম উদাসীনতার প্রমাণ। এমন অনৈতিক অগ্রাধিকারের কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরে মুখে রুটিনমাফিক শোক প্রকাশের বিবৃতি ছাড়া কার্যকর কোনো সংস্কার উদ্যোগ নিচ্ছে না। অন্যদিকে এ দুর্ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে রাজধানী ঢাকার আশপাশে স্কুল-কলেজের অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে ভয়াবহ নীতিহীনতা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি এমন উচ্চমাত্রায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পুরোপুরি নিয়মনীতি বহির্ভূত কাজ। এর ফলে বিমান ওঠানামার বিকট শব্দ, অনিয়ন্ত্রিত ও ঝুঁকিপূর্ণ উড্ডয়ন, এসব থেকে সৃষ্টি হওয়া মানসিক চাপ শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। অথচ এসব বিষয়ে নীতিমালা করার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সিভিল এভিয়েশনের। কিন্তু এক্ষেত্রেও তারা নীরব দর্শক। যা ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। এ দুর্ঘটনায় আরও একটি দুঃখজনক দিক ছিল রক্ত সংকট। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং জননিরাপত্তাসহ এর সঙ্গে জড়িত সবকিছুই এখন এক নতুনভাবে পর্যালোচনার সময় এসেছে। 
এ দুর্ঘটনা যেন আরেকটি স্ট্যাটাস, আরেকটি টকশোর বিষয় হয়ে হারিয়ে না যায় সেদিকে গুরুত্বের সঙ্গে দৃষ্টিপাত করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় রাষ্ট্র যদি সত্যিই এ থেকে শিক্ষা নিতে চায়, তবে তাকে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সচেতন, মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপত্তা যেন সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হয়ে ওঠে, প্রশিক্ষণ যেন শুধু দক্ষতা নয়, জীবনের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ শেখায়, দুর্নীতির পরিবর্তে যেন সততা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয় এমন নীতি নির্মাণ করাই এখন সময়ের সবচেয়ে জরুরি চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই একমাত্র গঠিত হবে নিরাপদ, মানবিক ও দূরদর্শী এক বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী 
ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা

 

প্যানেল/মো.

×