
প্রজন্মের জন্য গড়া চাই সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ
সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হয় এমন একটি আগামীকাল, যেখানে মানুষ শান্তি, নিরাপত্তা, সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে বাঁচতে পারে। এটি শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, বরং সামাজিক, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও নিরাপদ হওয়া উচিত। সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ মানে কেবল উন্নত ভবিষ্যৎ নয়, এটা এমন একটি দিগন্ত, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি, প্রযুক্তি ও মানবতা একসঙ্গে মিলেমিশে উন্নয়ন ও শান্তির পথে এগিয়ে যায়।
একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে তার মানুষদের স্বপ্ন, নিরাপত্তা ও সম্মিলিত প্রয়াসের ওপর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কী আদৌ একটি সুরক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? নাকি প্রতিনিয়ত অদৃশ্য অনিরাপত্তা আর গাফিলতির মাঝে প্রতিদিন একটু একটু করে সেই ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে ফেলছি? এই প্রশ্নটা নতুন নয়, কিন্তু উত্তরটা বারবার আমাদের চোখের সামনে বদলে যায়।
মাইলস্টোন স্কুলে সদ্য ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। স্কুলের মতো নিরাপদ স্থানেই যখন জীবনের নিশ্চয়তা থাকে না, তখন আমরা কোথায় নিরাপদ? মাইলস্টোন স্কুলে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল,আমরা এখনো সুরক্ষিত ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারিনি।
‘নিরাপত্তা’ শব্দটি আমাদের দেশে এখনো যেন বিলাসিতা। অথচ এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার। জীবন বাঁচিয়ে রাখতে, স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে, একটা ভবিষ্যৎ গড়তে সুরক্ষা থাকা জরুরি। একটি রাষ্ট্র তখনই নিরাপদ, যখন তার নাগরিকদের জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত থাকে। অথচ আমরা এমন এক দেশে বাস করছি, যেখানে কেউ জানে না, রাস্তা পার হতে গিয়ে বাঁচবে কি না। কেউ জানে না, স্কুলে গিয়ে সন্তান আবার ফিরে আসবে কি নাকেউ জানে না, ভাঙা ভবনে ঘুমিয়ে আবার জেগে উঠবে কি না। এ যেন এক অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিপাকে আটকে থাকা জীবন। এই অনিশ্চয়তা শুধু কোনো ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজকেই বিষিয়ে তোলে। সুরক্ষা মানে কেবল গার্ড না, মনোযোগের প্রতিফলন।
আমাদের দেশে সুরক্ষা মানেই বুঝি নিরাপত্তারক্ষী, ধাতব গেট, সিসিটিভি ক্যামেরা। অথচ প্রকৃত নিরাপত্তা আসে পরিকল্পনা, সচেতনতা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থেকে। যেখানে স্কুল ভবনের মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, যেখানে জরুরি প্রশিক্ষণ নেই, ফায়ার ড্রিল হয় না, যেখানে প্রতিদিন টেন্ডার আর কমিশনের খেলায় নিরাপত্তা কেবল কাগজে থাকে, সেখানে সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ কেবল কল্পনা। শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানও অনিরাপদ। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হলে আমাদের আজকেই দেখতে হবে। একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ঠিক একজন অভিভাবকের মতো- নিরাপত্তা দেওয়া, দায়িত্ব নেওয়া, আগাম বিপদের আভাসে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আমরা কবে সেই রাষ্ট্র পাব, যে নাগরিকের জীবনের মূল্য বুঝবে? যে ভবিষ্যতের কথা আগেই ভাববে, কেবল ক্ষয় দেখে নয়?
সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের কোনো ম্যাজিক নেই। কিন্তু কিছু বিষয় যথাযথভাবে মেনে চললেই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। যেমন- শারীরিক নিরাপত্তা, শিশুদের স্কুলে নিরাপদ যাতায়াত, নারীদের রাস্তায় নিরাপদ চলাফেরা, শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, মানসিক নিরাপত্তা, ট্রমা, বিষণ্নতা ও উদ্বেগমুক্ত সমাজ অপরাধ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার থেকে দূরে থাকা মানসিক প্রশান্তি, প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা, তথ্যের গোপনতা রক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার, শিক্ষা ও মানবসম্পদের নিরাপত্তা, পরিবেশগত নিরপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্রিয় উদ্যোগ ইত্যাদি। একটা সুরক্ষিত ভবিষ্যৎই আমাদের আগামী দিনগুলোতে নিরাপত্তা দিতে পারে।
এছাড়াও রাষ্ট্রের উচিত বিভিন্ন নীতিমালা কার্যকর করা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকলকে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু যথাযথভাবে দায়িত্বগুলো কেউই ঠিকভাবে পালন করে না, তখনই ভবিষ্যতের ওপর ছায়া নেমে আসে। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি। গাড়ি দুর্ঘটনা হলে ড্রাইভারকে দোষ দিই, ভবন ধসে পড়লে কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে দোষ দিই, বন্যা হলে প্রকৃতিকে দোষ দিই। কিন্তু আসলে কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাই। এই অভ্যাস বদলাতে না পারলে, শত উন্নয়নেও আমাদের ভবিষ্যৎ অরক্ষিতই থেকে যাবে।
সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আমাদের দরকার নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব, তরুণ সমাজের জোরালো অংশগ্রহণ, দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তানীতি, সততা ও জবাবদিহিতা। এছাড়াও স্কুলে শিশুদের শুধু পড়াশোনা নয় পাশাপাশি নিরাপত্তাবোধ শেখাতে হবে। শুধু জনগণ নয় রাষ্ট্রকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন নগর পরিকল্পনায় বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আর কোনো বিপজ্জনক কার্যক্রম চলবে না এই সিদ্ধান্ত নীতিগতভাবে নিতে হবে। স্কুল, হাসপাতালের পাশে সেনা বা বিমান প্রশিক্ষণ চলবে না। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাধন এবং প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। আর দেশের প্রতিটি সিদ্ধান্তে প্রধান বিবেচনা হিসেবে থাকবে জনমানুষের সুরক্ষা।
উপরোক্ত এ বিষয়গুলো রাষ্ট্র এবং জনগণ যথাযথভাবে পালন করতে পারলেই আমরা একটা সুন্দর এবং সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারব। শুরু হোক আজই, এখান থেকেই।
লেখক : শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
প্যানেল/মো.