ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

শব্দস্রোতে জাগ্রত বিপ্লব

মিরাজ মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৭:৫৭, ৯ জুলাই ২০২৫

শব্দস্রোতে জাগ্রত বিপ্লব

শব্দ- এই এক অদৃশ্য শক্তি, যা কখনো প্রশান্তির সুধা হয়ে ঝরে, কখনো আবার দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। কখনো শব্দ ভালোবাসার মায়াজালে জড়ায়, কখনো আবার তীক্ষè বর্শার মতো হৃদয়ে বিঁধে যায়। ইতিহাস সাক্ষী, শব্দের স্রোতই বদলে দিয়েছে সভ্যতার গতিপথ, জাগিয়ে তুলেছে বিপ্লবের আগুন, ঝরিয়েছে রক্ত, জন্ম দিয়েছে নতুন ভোর।২০২৪ সালের জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়, যেখানে শব্দের শক্তি অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠেছিল। এক ভুল শব্দচয়ন, এক স্বৈরাচারী উচ্চারণ, এক বিতর্কিত বাক্য দেশজুড়ে দাবানল ছড়িয়ে দেয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথার প্রতিক্রিয়ায়, শিক্ষার্থীদের রক্তে যেন বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। সেই আগুন নিভে যাওয়ার ছিল না, কারণ এর ইন্ধন ছিল যুগের পর যুগের বঞ্চনা, বৈষম্য, অন্যায় ও নিপীড়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এক শব্দ রাজাকার! এই শব্দ একসময় ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়কে নির্দেশ করত, অথচ সেই শব্দকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলো। ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!’ এই স্লোগান বজ্রনিনাদের মতো আকাশ কাঁপিয়ে তোলে। রাতের নিস্তব্ধতাও সে শব্দের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে, রাস্তায় নামে হাজারো তরুণ প্রাণ, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিরোধের অগ্নিসংগীত। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ৯ দফার গর্জন এক সময় এক দফায় এসে দাঁড়ায় স্বৈরাচারের পতন চাই! প্রতিটি স্লোগান, প্রতিটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর যেন বারুদের মতো বিস্ফোরিত হতে থাকে। রক্তাক্ত পথের ওপর দাঁড়িয়ে, বিপ্লবীরা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঘোষণা করে- এই অন্যায়ের ইতি ঘটবেই। শব্দের শক্তি কতটা প্রবল, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, শব্দই জাতিকে জাগিয়ে তোলে, শব্দই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মশাল জ্বালায়। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার ডাক, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রতিটিতেই শব্দের স্রোত ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। একেকটি বিপ্লবী গান, একেকটি স্লোগান, একেকটি প্রত্যয়ী উচ্চারণ সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, ভয়কে করেছে তুচ্ছ। তবে সেদিন কিছু প্রাণ শব্দহীন, নিঃশব্দ আর অসাড় হয়ে লুটিয়ে পড়েছিল ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে কেউ বা ধ্বংসাত্মক উন্মত্ততায় রূপ নেওয়া হিংস্র হায়েনাদের নিষ্ঠুর থাবায়। সেই শব্দ কেড়ে নিয়েছিল মুক্ত আকাশের নিচে খেলায় মগ্ন নিষ্পাপ রিয়ার প্রাণ। সেই শব্দ নিভিয়ে দিয়েছিল সানন্দে দাদির হাত ধরে আইসক্রিম কিনতে যাওয়া ছোট্ট মুসার জীবনপ্রদীপ। আর ঘরের অন্তরীণে নিঃশব্দে ঝরে গিয়েছিল ছোট্ট সামিরের তাজা রক্ত। জুলাইয়ের সেই গুলির শব্দ কেবল ধ্বনি ছিল না- তা ছিল প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী হাহাকার, এক অশান্ত আতঙ্কের বিষবৃক্ষের বীজ।
জুলাই বিপ্লব ছিল শব্দের সেই মহাকাব্য, যেখানে একেকটি শব্দ ছিল প্রতিবাদের ঢেউ, প্রতিটি বাক্য ছিল বিদ্রোহের বজ্রধ্বনি। শিক্ষার্থীদের বুকের গভীরে যে ক্ষোভ লুকিয়ে ছিল, শব্দের বিস্ফোরণে তা উদ্গীরিত হলো। শব্দ জাগিয়ে তুলল এক নতুন স্বপ্ন, এক নতুন প্রত্যাশা যেখানে অন্যায় থাকবে না, বৈষম্য থাকবে না, বিলীন হয়ে যাবে স্বৈরাচারের কালো ছায়া।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে

প্যানেল/মো.

×