
জুলাই ২০২৪। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে রক্তাক্ত আরেকটি অধ্যায় যুক্ত হলো এই মাসে। ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করে ২০২৪ সালের ৫ জুন। ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ৩০, নারী ১০, পশ্চাৎপদ জেলা ১০, সংখ্যালঘু ৫ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু সরকারের এই ব্যবস্থাকে ছাত্ররা মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে, যার মধ্যে ছিল বিক্ষোভ মিছিল, গণসমাবেশ এবং অবরোধ। আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ২-৬ জুলাই প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। ৭ জুলাই সারাদেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে আখ্যা দেন। শুধু কটাক্ষেই থেমে থাকেননি বরং গুম, খুন, দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলনকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করেন। আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার যে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বর্বরতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিরস্ত্র আবু সাঈদ পুলিশের সরাসরি গুলিতে শহীদ হন। নির্মম হত্যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষোভে, ক্রুধে ফেটে পড়ে। রূপ নেয় জাতীয় আন্দোলনে। ছাত্রদের শেষ আশা মুক্তি অথবা মৃত্যু। স্কুল, মাদ্রাসা, সরকারি/বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকও অবরোধ-বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগ দেন। আন্দোলন দমন করতে সরকার ১৮ ও ১৯ জুলাই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয় এবং ইস্যু পরিবর্তনের অপকৌশল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবু থামেনি মানুষ। শিক্ষার্থীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, পেশাজীবী, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষ কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমে আসে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি সব ব্যবহার করেও থামাতে পারেনি জনতার ঢল। আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে লাখো মানুষের সমাবেশ। একদফা একদাবি শেখ হাসিনার পদত্যাগ। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের পাল্টা হামলায় আবারও রক্তের বন্যা বয়ে যায়। ৫ আগস্ট ভোরে ঢাকার রাজপথ ছাপিয়ে জনতার ঢল এগোতে থাকে গণভবনের দিকে। অবশেষে এ দিন শেখ হাসিনা লুকিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন। কি থেকে কি হয়ে গেল। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের লাশ, আত্মার অভিশাপ। এছাড়াও কত শত বেনামি গুম লাশের আত্মার অভিশাপ তার হিসাব কেউ জানে না। অভিশপ্ত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলো। নতুন স্বপ্নের, নতুন আশার যে জুলাইয়ের সূর্য বাংলার আকাশে উদিত হলো তার বাস্তবায়ন কতটুকু হবে দেশবাসী এখন সেই প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে।
তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ থেকে
প্যানেল/মো.