ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

দুর্নীতি জালিয়াতি প্রতারণা

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:১৯, ১ আগস্ট ২০২৫

দুর্নীতি জালিয়াতি প্রতারণা

এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, পৃথিবী নামক এই গ্রহে কোনো জাতিরাষ্ট্রই দুর্নীতি-প্রতারণার নানামুখী প্রকরণমুক্ত নয়। এসব অপাংক্তেয়-অনভিপ্রেত প্রত্যয়ের যথেচ্ছাচার এবং চলমান ঘটনাগুলোর ইতিবৃত্ত দেশবাসী প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যম সূত্রে সম্যক অবগত হচ্ছেন। দেশব্যাপী বহুমাত্রিক কুৎসিত জালিয়াতি-মিথ্যাচার-কদাচার-অরাজকতাসহ প্রতারণামূলক অপরাধ সর্বত্রই দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে চলছে। সমগ্র জনগণ এতে ভীষণ বিভ্রান্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত। সর্বনিম্ন থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান-ব্যাংক-বীমা-পুঁজিবাজার-আবাসন প্রকল্প-সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদ-পদায়ন, ভর্তি-নিয়োগ-টেন্ডার বাণিজ্যসহ এমন কোনো কর্মযজ্ঞ নেই যাতে অধিকাংশ সংস্থা-জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে প্রতারণা-জালিয়াতির শিকারে নিপতিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সর্বস্ব হারিয়ে, মান-মর্যাদা সুরক্ষায় প্রায় দেউলিয়ার মুখোমুখি বিপর্যস্ত বাংলাদেশের মানুষ। যদিও জনশ্রুতি ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক গণমাধ্যম সূত্র থেকে এসব প্রতারক-জালিয়াত চক্রের পৃষ্ঠপোষকদের পরিচিতি স্ব স্ব অঞ্চলে কমবেশি সবারই জানা; অদৃশ্য কারণে এদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ যেন সুদূর পরাহত। 
চিহ্নিত নাগ-নাগিনীরা ছলচাতুরী-অভিনয়শৈলী-লবিং তদবির বাণিজ্য-অর্থলিপ্সু অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে অপাংক্তেয়-অযাচিত এসব কদর্য কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে দেশকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখার বিষয়। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ-আরোপিত ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির  আগ্রাসনে এরা এত বেশি শক্তিশালী; সৎ-যোগ্য-দক্ষ-মেধাবী-দেশপ্রেমিক সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে এদের প্রতিরোধ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি-ঘুষ-নির্লজ্জ নগদ অর্থ লেনদেনে সব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অশুভবলয়ে সংঘটিত জঘন্য অপরাধ কর্মে জড়িত-নেতৃত্বে রয়েছে অন্ধকারের পূজারী অর্থ ও ক্ষমতা লিপ্সু দানবরূপী মাফিয়া চক্র। ‘ম্যানেজ’ অপসংস্কৃতির নগ্নতায় এদের আগ্রাসী কুপদচারণা সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অভিযানে সময়ের ব্যবধানে কিছুটা স্থিমিত হলেও; স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার তারা এত বেশি অদমনীয় শক্তিতে সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণ বিশ্লেষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 
সাম্প্রকিতকালে দেশব্যাপী ডিজিটাল, অ্যানালগসহ নানা প্রতারণার বেড়াজালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জনজীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। প্রতারণার বহুমাত্রিকতায় সব স্থানে নিরাপদে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ ডিজিটাল দুনিয়ার বৃহৎ অংশজুড়েই ওৎ পেতে আছে বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদ। ডিজিটাল প্রতারণার পর্বতসম অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই হচ্ছে মোবাইলে অর্থ লেনদেনের প্ল্যাটফর্মকেন্দ্রিক। বিজ্ঞজনদের মতে, দেশে প্রতারণামূলক অপরাধ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সমাজে সুদূর অতীতকাল থেকে প্রতারণামূলক অপরাধ বিরাজ করলেও; নতুন নতুন কৌশলের আবির্ভাবে প্রতারণামূলক অপরাধ নতুন মাত্রিকতা পেয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে এর মাত্রা বেড়েছে আরও বহুগুণ। পূর্বে প্রতারকচক্র মানুষের অসচেতনার সুযোগে সাধারণের আস্থা অর্জন করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিলেও; তা ছিল সামান্য বা কিছু পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ধরনের অপরাধের শিকার হতো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশার মানুষ। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা এবং চাওয়া-পাওয়ার স্বল্পতার কারণে সহজে কোনো কিছু অর্জন করা থেকে নিজেকে দূরে রাখত। কিন্তু অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতির উত্থান এবং অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি মানুষের জীবনধারণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। বর্তমানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজন বহির্ভূত উচ্চাভিলাষের বশবর্তীতায় অপ্রয়োজনীয় অনেক চিন্তা-চেতনা পরিলক্ষিত। এই সুযোগে প্রতারকচক্র আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে আবার অনেকে অল্পে রক্ষা পাচ্ছে।   
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতারণার সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতারকদের নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শিক্ষিত-অশিক্ষত অনেকেই কপুকাত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চাকরিজীবীরাও এদের কদর্য প্রতারণার শিকার। ভুক্তভোগীরা প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হলে প্রতারণার ভয়ংকর কৌশলগুলো কদাচিৎ জনসম্মুক্ষে উন্মোচিত হয়। ব্যাংকিং সেক্টরে অনলাইনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জালিয়াতি ও প্রতারণার ব্যাপকতাও বাড়ছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেওয়ার কথা বলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার দৃষ্টান্তও নেহায়েত কম নয়। ইতোমধ্যে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন এজেন্টের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। চলমান সময়ে দেশে সংঘটিত সমধিক আলোচিত প্রতারণার মধ্যে রয়েছে- বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ, প্রতারণার মাধ্যমে ভাটারায় ব্যবসায়ীর ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তা সেজে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, নড়াইলে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির নামে মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ আয়, ঢাকার লালবাগ এলাকায় বিভিন্ন অনলাইন আউটসোর্সিং কাজ দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়া, অনলাইনে ইলিশ বিক্রির নামে পেজ খুলে অভিনব কৌশলে প্রতারণা ইত্যাদি।  
২০২৩ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টেলিগ্রামে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিক্রি এবং এসব তথ্য দিয়েই ব্যাংকের কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার নামে নানান প্রতারণামূলক ব্যবসার ছড়াছড়ি অতিশয় দৃশ্যমান। ভুয়া তথ্যের এসব ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সক্রিয় রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ শক্তিশালী একটি অসাধু চক্র। তথ্য বিক্রি বাড়াতে দেশের প্রতিষ্ঠিত মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকটি ব্যাংকের নামও ব্যবহার করে কৌশলে গ্রাহকদের ধোঁকা দেওয়ার এই ব্যবসা চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতানুসারে, যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজ থেকে তথ্য বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে এমনিতেই মানুষ এ নিয়ে অস্বস্তিতে আছে; এখন তাদের বিভ্রান্ত করাটা আগের চেয়ে সহজ। ফলে সত্য-মিথ্যা নানান রকম কথা বলে সুযোগসন্ধানী কেউ কেউ ব্যবসা করে থাকতে পারে। এ ধরনের তথ্য যারা অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রি করছে এবং প্রলোভনে পড়ে যারা কিনছে, উভয়েই সমান অপরাধী। কাজেই যারা এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে এলে শাস্তির সম্মুখীন হবে। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, এমন তথ্য কিনে কখনই টাকা পাওয়ার কোনো সুযোগ বাংলাদেশে নেই।   
চলতি বছরের মে মাসে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে সম্প্রতি বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংস্থাটির নাম ব্যবহার করে সংঘটিত প্রতারণামূলক কার্যকলাপ নিয়ে সতর্কতা জারি করে এ ধরনের ভুয়া প্রস্তাব ও বার্তা সম্পর্কে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। সতর্কবার্তায় উল্লেখ করা হয় যে, প্রতারকরা জাইকার নাম ও লগো ব্যবহার করে ভুয়া সঞ্চয় প্রকল্প, ঋণ সুবিধা ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এসব প্রতারণামূলক কার্যক্রমের ভুয়া দাবির মধ্যে রয়েছে- জাইকা প্রদত্ত ব্যক্তিগত ঋণ সুবিধা এবং এক্ষেত্রে অগ্রিম অর্থ ও অনেক ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াকরণ ফিও দাবির পাশাপাশি কিছু ফেসবুক পোস্টে জাইকার নাম ব্যবহার করে ভুয়া সঞ্চয় প্রকল্প ও চাকরির বিজ্ঞাপনও দেওয়া হচ্ছে। একই মাসে পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও প্রতারক চক্রের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য পরিচয়ে এবং বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয় যে প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিগত মাসেও প্রশাসন বিভাগ থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতারণামূলক ফাঁদ থেকে নিরাপদ থাকতে অধিকতর সাবধানতা অবলম্বন বিষয়ে সাতটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 
দুর্নীতি-জালিয়াতি-প্রতারণার ব্যাপকতা সমাজের এত বেশি গভীরে প্রোথিত হয়েছে; তা সমূলে উৎপাটন করা না গেলে জাতির সব উন্নয়ন-অর্জন বিশ্বপরিমণ্ডলে উঁচুমাত্রিকতার ভাবমূর্তি ধসে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা প্রবল। প্রতারণা ও জালিয়াতিকে প্রতিরোধ করার দৃঢ়চেতা-নির্ভীক-সাহসিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অচিরেই দেশ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেই। যথোপযুক্ত বস্তু-সত্যনিষ্ঠ-ন্যায়পরায়ণতায় উঁচুমার্গের ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে নৈর্ব্যক্তিক পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনে সংঘটিত কর্মযজ্ঞে অভিযুক্তদের বিচারিক আদালতে প্রমাণিত অপরাধের শাস্তির চূড়ান্ত ব্যবস্থা দৃশ্যমান করতে হবে। নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টির অশুভ প্রচেষ্টার বিনাশ এবং সব অপশক্তির ঘৃণ্য কুপরিকল্পনা নিধন করার জন্য শুভ-সুন্দর-কল্যাণময়ী শক্তির একতা দেশ রক্ষার যুদ্ধে অপরিমেয় ব্রত ও চূড়ান্ত বিজয়ের অনবদ্য দৃষ্টান্ত নির্মাণে অত্যুজ্জ্বল হবে।   
লেখক : শিক্ষাবিদ

প্যানেল/মো.

×