ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

শহরে বাড়ছে একাকিত্ব

তোফায়েল শেখ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২০:১৭, ১ আগস্ট ২০২৫

শহরে বাড়ছে একাকিত্ব

নগর জীবনের ঘনত্ব যত বাড়ছে সম্পর্কের গভীরতা যেন ততই হারিয়ে যাচ্ছে। উঁচু দালান ব্যস্ত রাস্তা রঙিন বাতি সবই আছে এই শহরে নেই শুধু মন খুলে কথা বলার মানুষ, নেই ক্লান্ত বিকেলে কারও সঙ্গে হাঁটার সময়। ব্যস্ত কোলাহল পূর্ণ এই রঙিন শহরে রয়েছে এক ভয়ার্ত নীরবতা ও অন্ধকার। এই অন্ধকারেই জন্ম নিচ্ছে ভয়ংকর সামাজব্যাধি ‘একাকিত্ব’। শহরের প্রতিনিয়ত একাকিত্ব বাড়ছে আর মানুষ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কের মানচিত্র থেকে। একাকিত্ব মানে কি শুধু একা থাকা? একাকিত্ব এক ধরনের মানসিক অভাববোধ। কেউ পাশে থেকেও যখন আমাদের মনের কথা না বুঝে সেটাকেও একাকিত্ব বলা হয়। একজন মানুষ হয়তো প্রতিদিন অফিস করছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় তবুও তার হৃদয়ের গভীরে জমে থাকতে পারে নিঃসঙ্গতার কুয়াশা। শহর কি একাকিত্ব জন্মায়? হ্যাঁ, শহরকে দায়ী না করে উপায় নেই। নগরায়ন আমাদের অনেক সুবিধা দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের আনন্দ আর পারস্পরিক নির্ভরতাকে। পাড়া-প্রতিবেশী সঙ্গে সম্পর্ক, ঘরোয়া আড্ডা,উঠোনে বসে গল্প, বাজারে চায়ের দোকানে আড্ডা সবই যেন লাল ইটের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। এখন শহরের বাসিন্দারা জানে না পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, বছরের পর বছর পার হয়ে যায় তবুও হয় না দু-একটি সৌজন্য কথা। শহরের কাঠামো, খোলা জায়গার অভাব এবং একঘেয়ে রং আমাদের আরও বিষণ্ন করে তোলে। আমরা এমন যুগে বাস করছি যেখানে ভার্চুয়ালি শত শত ফলোয়ার, হাজার হাজার লাইক তবু বাস্তবে এমন বন্ধু নেই যার কাছে নিজের কষ্ট বলে কাঁদা যায়। স্মার্টফোন আমাদের বিশ্বকে কাছে এনেছে ঠিকই কিন্তু আমাদের পাশের মানুষটিকে যেন দূরে ঠেলে দিয়েছে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে থাকলেও প্রত্যেকের চোখ মোবাইলে, এ যেন এক অদ্ভুত একাকিত্ব। তরুণ সমাজ সবচেয়ে বেশি একাকিত্বে ভুগছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেখানে প্রাণচাঞ্চল্য ও বন্ধুত্ব থাকার কথা সেখানেও এখন অনেক শিক্ষার্থী নিঃসঙ্গতায় ভোগে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা প্রতিদিন ক্লাসে যান ঠিকই কিন্তু কারো সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়তে পারেন না। ফলাফল স্বরূপ জমে থাকে বিষণ্নতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও অনাগ্রহতা। ১৮-২৯ বছর বয়সীরা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি একাকিত্বের শিকার। প্রতিযোগিতা, চাকরির চাপ, অনিশ্চয়তা সব মিলে তারা এক অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে আছে। এটার সমাধান কোথায়? একাকিত্বের অন্ধকার দূর করা সহজ নয় তবে অসম্ভবও নয়। প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সামজিক উদ্যোগ। যেমন: পারিবারিক বন্ধন মজবুত করা, পরিবারকে সময় দেওয়া, একসঙ্গে খাবার খাওয়া, আড্ডা দেওয়া। এই ছোট কাজগুলো আমাদের অনেক মানসিক চাপ কমায়। ভালো বন্ধু তৈরি করা এবং সম্পর্ক বজায় রাখা; ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড নয় বাস্তব জীবনে পাশে থাকার মতো মানুষ দরকার। ডিজিটাল ডিটক্স অর্থাৎ প্রতিদিন কিছু সময় ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা। এছাড়াও এলাকাভিত্তিক পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার আয়োজন করলে সামাজিক সংযোগ বাড়বে। আর একাকিত্ব নয়, গল্পটা হোক একসঙ্গে পথ চলার। মোবাইল স্ক্রিন নয়, চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা হবে বন্ধুত্বের প্রতীক। যেখানে ফেসবুকের চেয়ে পাশের মানুষটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। মানুষ একা জন্মায় না, একা বাঁচেও না। সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়েই মানুষ তার পরিচয় খোঁজে। তাই সম্পর্কই হোক শহরের নতুন সংবেদন।

প্যানেল/মো.

×