ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২

আরবি ভাষা: ধর্মীয় গণ্ডি পেরিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন দিগন্ত

আল-আমিন

প্রকাশিত: ২০:০৭, ৩ আগস্ট ২০২৫; আপডেট: ২১:৫৬, ৩ আগস্ট ২০২৫

আরবি ভাষা: ধর্মীয় গণ্ডি পেরিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন দিগন্ত

ছবি: আল-আমিন

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত এবং জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা আরবির চর্চা ও গুরুত্বের একটি অন্যতম কারণ হলো ধর্ম। জনবহুল এই দেশটির প্রায় ৯০ ভাগ জনসংখ্যা মুসলিম হওয়ায় ধর্মীয়ভাবে এ ভাষা চর্চা ও শিক্ষার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে আলাদা একটি উৎসাহ ও আবেগ রয়েছে। কেননা, ইসলাম ধর্ম এ ভাষা শিক্ষা ও চর্চার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এছাড়াও এ ভাষার মর্যাদা ও শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণনায় রয়েছে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অনেক ইঙ্গিত। পবিত্র কুরআনের ভাষাকে আল্লাহ সহজ বলে উল্লেখ করে এর থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য বলেছেন। ইসলামের নবী মোহাম্মদ (স:) আরবি ভাষা শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বলেন: “তোমরা আরবিকে ভালোবাসো তিন কারণে; কারণ, আমি আরবি ভাষাভাষী, কুরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতের ভাষা আরবি।” এছাড়াও পবিত্র কুরআনের এক বর্ণ উচ্চারণে দশ নেক/সওয়াব/পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। কুরআন এবং হাদিসের ভাষা যেহেতু আরবি, সেহেতু এই আয়াত এবং হাদিসগুলোও এই ভাষা শিক্ষা-চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদান করে। সুতরাং, মুসলিম প্রধান একটি দেশে আরবি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যদিও ধর্মীয় দিক থেকে এ ভাষা চর্চা ও শিক্ষার যে গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা, বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে অনেকটাই ব্যতিক্রম। যেমন বলা হয়ে থাকে, মুসলিম তথা ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জীবন চালনার প্রথম ও প্রধান নির্দেশিকা হলো আল কুরআন যা আরবি ভাষায় অবতীর্ণ। দ্বিতীয় উৎস হাদিস সেটাও আরবি ভাষায়। যা মুখস্থ করার বাধ্যবাধকতা যেমন আছে তেমনি অর্থ বোঝার আবশ্যকতাও অনেক। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, দু-একটা শুদ্ধ আরবি (আয়াত/সুরা/দোয়া) জানেনা এমন লোক হয়তো পাওয়া কঠিন, কিন্তু অর্থ বুঝে যথাযথভাবে আরবি পড়েন বা পড়তে পারেন এমন লোকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তাহলে বলাই যায়, ধর্ম আমাদের আরবি ভাষা শিক্ষায় যে গুরুত্বারোপ করেছে তা হয়তো আমাদের কাছে যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। অন্যথায় এ বিষয় নিয়ে আমরা অবচেতন এবং অসচেতন।

এবার আসি আরবিকে শুধুই ধর্মীয় মাপকাঠিতে নয় বরং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিবেচনায় একটু মূল্যায়ন করি। বিশাল জনসংখ্যার জনবহুল এই দেশটির আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুক্তি এবং উন্নতির অন্যতম একটি বাহন হতে পারে এই আরবি ভাষা। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয় রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী-প্রেরিত অর্থকে। যা প্রবাসে অবস্থানরত/কর্মরত কর্মীরা তার নিজ দেশে প্রেরণ করে থাকে। আর এ জন্যই প্রবাসীদের বলা হয়ে থাকে রেমিট্যান্স যোদ্ধা। যাদের দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমই এদেশের বিপদসংকুল অর্থনীতিকে শক্তিশালী এবং মজবুত অবস্থানে টিকিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনয়নসহ প্রত্যেকটি স্তরে রয়েছে এর অবিচ্ছেদ্য এবং অনস্বীকার্য অবদান। শুধু অর্থনীতিই নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে তাদের অবদান বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। এমনকি দেশের রাজনীতিতেও। ২০২৪ এর ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে প্রবাসীরা যখন তাদের রেমিট্যান্স সাট-ডাউন ঘোষণা করেছিল, তখনই ফ্যাসিস্ট তথা স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। যা প্রমাণ করে এই প্রবাসীরা শুধুই দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড নয় বরং দেশের সকল ক্ষেত্রেই তাদের অবদানের অবিচ্ছেদ্য এবং অতুলনীয়। ২০২২ এর আদমশুমারি সহ বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ৭৫ লাখেরও বেশি মানুষ প্রবাসী হিসেবে বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। তন্মধ্যে প্রায় ২৮-৩৫ লাখই মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে অবস্থানরত। আর সেসব দেশের ভাষাও আরবি। অর্থাৎ মোট প্রবাসী বাংলাদেশীর অর্ধেকই এই আরবি ভাষাভাষী দেশগুলোতে বসবাসরত।

এবার রেমিট্যান্সের দিকে একটু লক্ষ করি। গত ৩ জুন ২০২৫ তারিখের সময় টিভির অনলাইন রিপোর্টে দেখা গেছে, মে ২০২৫-এ মোট ২৯৬ কোটি ৯৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারমধ্যে শুধু সৌদি আরব থেকেই এসেছে ৫৩ হাজার কোটি ৩৩ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। এর পরেই অবস্থান আরব আমিরাতের। আর এই দুটি দেশ থেকেই আগত রেমিট্যান্স মোট রেমিট্যান্সের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এভাবে আরবি ভাষাভাষী সব দেশের রেমিট্যান্স হিসেব করলে দেখা যাবে সিংহভাগই আসছে এই দেশগুলো থেকে। তাহলে এ কথা অকপটে বলা যেতে পারে যে, আরবি ভাষাভাষী দেশগুলো থেকে আগত রেমিট্যান্সই আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। যা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভেশনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেহেতু সিংহভাগ রেমিট্যান্সই আসছে এই আরব দেশগুলো থেকে এবং তাদের ভাষা যেহেতু আরবি, সুতরাং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও আরবি ভাষার ভূমিকা স্পষ্টই প্রতীয়মান।

এখন বিবেচনার বিষয় হলো, যে পরিমাণ লোক প্রবাস জীবনের এই ভয়াবহ কষ্টে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে বা যা পারিশ্রমিক পাচ্ছে তা তাদের পরিশ্রমের তুলনায় যথার্থ প্রাপ্তি, নাকি এর পরিমাণ আরো বেশি হতে পারত? যদি এটা পর্যাপ্ত না হয়, তাহলে কেনইবা এটার পরিমাণ তাদের পরিশ্রমের তুলনায় যথার্থ নয়? আসুন সেটার খানিকটা মূল্যায়ন করা যাক। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আরব দেশগুলোতে প্রবাসী হিসেবে কর্মরত অধিকাংশ বাংলাদেশী লোকই কায়িক শ্রমের পেশাগুলোতে যুক্ত। এবং তারা তাদের যোগ্যতার মাপকাঠিতেই এই ধরনের তাদের পেশা-কর্ম সংস্থানে যুক্ত হচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন থাকে যে, কেন এই কায়িক শ্রম সংশ্লিষ্ট পেশা তাদের বেছে নিতে হচ্ছে? এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ভাষাগত অদক্ষতা। ভিন্ন একটি দেশ, ব্যতিক্রম আবহাওয়া, নতুন মানুষ এমনকি নিজেকে প্রকাশের একমাত্র উপায় মুখের ভাষা সেটাও অজানা। এমতাবস্থায় প্রতিকূলতা কেবল একজন প্রবাসী ছাড়া বোঝা তো দূরে থাক আঁচ করাটাও অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। যখন কোনো লোক একটু ভালো থাকতে, পরিবার-সন্তানদের ভালো রাখতে এবং তাদের মুখে হাসি ফোটাতে বিদেশে পাড়ি জমান, তখন তার যত কষ্টই হোক না কেন এ ধরনের পেশা বেছে নেওয়ার কোনো বিকল্প থাকে না। কারণ অধিকাংশ প্রবাসী বিদেশে পাড়ি জমান তাদের ভিটা-মাটি সবকিছু বেচে দিয়ে। ফলে তার এবং তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হয়ে যায় প্রবাস জীবনের এই পেশাগুলো।

যদিও এমন সব পেশাতে যুক্ত হওয়ার পিছনে আরো অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু অন্যতম প্রধান কারণ যেহেতু ভাষাগত অদক্ষতা, সুতরাং এই ভাষাগত অদক্ষতা দূরীকরণে আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। ভাষাগত এই অদক্ষতা দূরীকরণে প্রথম করণীয় হলো আরবি ভাষা সম্পর্কে আমাদের সমাজ-দেশের প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত ধারণা দূর করা যে, “এটি একটি ধর্মীয় তথা ইসলামি ভাষা যা কেবল ইসলাম ধর্ম প্রচারক ও মুসলমানরাই শিখবেন এবং ইসলামের জন্যই শিখবেন।” যেহেতু বাংলাদেশ থেকে আরব দেশে কেবল মুসলমানরাই প্রবাসী হিসেবে পাড়ি দেন না এবং ধর্মপ্রচারও তাদের উদ্দেশ্য নয়, সুতরাং আরবি ভাষাকে ধর্মীয় বিবেচনায় রাখলে সেটা হবে বাস্তবতা বর্জিত বিবেচনা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশীরা যেখানে আরবি ভাষাকে কেবল মুসলমান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্ধারণ করেছি, সেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রায় ৬-৮ মিলিয়ন লোক আরবদেশগুলোতে কর্মরত। এমনকি ব্যতিক্রম হলো তাদের অধিকাংশই অফিসিয়াল/দাপ্তরিক পেশায় কর্মরত। এর বড় কারণ হচ্ছে তাদের অন্য সব দক্ষতার পাশাপাশি ভাষাগত দক্ষতা।

সুতরাং, বাংলাদেশী হিসেবে আমাদেরও উচিত হবে আরবিকে কেবল ধর্মীয় ভাষা হিসেবে বিবেচনা না করে এটিকে পৃথিবীর অধিক ব্যবহৃত এবং আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি আরব প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা। আর যারা আরব দেশের প্রবাস জীবনকে বেছে নিতে চায় তাদের ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকারি-বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া। যাতে আমাদের দেশের এই প্রবাসী ভাইবোনেরা তাদের ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবাস জীবনে তাদের প্রত্যাশিত পেশা খুঁজে নিয়ে দেশ ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্তত ভাষাগত অদক্ষতা যেন তাদের প্রত্যাশিত পেশা বাছাইয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা না হয়।

লেখক: আল-আমিন
বিএ, এমএ: আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, বিজিবি হেড কোয়ার্টার, পিলখানা, ঢাকা।

ফারুক

×