
আপনি কি শান্ত নির্জন গ্রামে বড় হয়েছেন, নাকি কংক্রিটের জঙ্গলে ঘেরা ব্যস্ত কোনো শহরে? প্রশ্নটা শুনে অদ্ভুত লাগলেও এর পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক স্বাস্থ্যঝুঁকির ইঙ্গিত। নতুন এক গবেষণা বলছে, আপনার জীবনের প্রথম পাঁচ বছর কোথায় কেটেছে, সেটাই ভবিষ্যতে টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস কী
টাইপ ১ ডায়াবেটিস (T1D) একটি দীর্ঘমেয়াদি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভুলবশত অগ্ন্যাশয়ে অবস্থিত ইনসুলিন তৈরির কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন হয় না বা খুব কম হয়। ইনসুলিন হরমোনটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ইনসুলিনের অভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, যার ফলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া দেখা দেয়। সাধারণত এই রোগ শৈশব, কৈশোর কিংবা তরুণ বয়সে ধরা পড়ে, তবে যেকোনো বয়সেই হতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীকে সারা জীবন ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়।
গবেষণার বিস্ময়কর ফলাফল
সুইডেনে পরিচালিত নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা জীবনের প্রথম পাঁচ বছর গ্রামীণ এলাকায় কাটিয়েছে, তাদের মধ্যে টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শহরবাসীদের তুলনায় ৩০ থেকে ৮০ শতাংশ বেশি। গবেষণাটি সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যামি সেবরাউই এবং অধ্যাপক সোফিয়া গুডবজর্নসডটির নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং এটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ভিয়েনায় ইউরোপীয় ডায়াবেটিস গবেষণা সংস্থার বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে।
অতীতে যেসব গবেষণা করা হয়েছে, সেগুলো মূলত রোগ নির্ণয়ের সময় রোগী কোথায় থাকতেন, তা বিবেচনা করেছে। তবে নতুন এই গবেষণাটি ব্যতিক্রম। গবেষকরা ২০০৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২১ হাজার ৭৭৪ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। জন্ম থেকে রোগ নির্ণয়ের আগ পর্যন্ত তাদের আবাসস্থলের তথ্য সংগ্রহ করে উচ্চ ও নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮ শতাংশই পুরুষ এবং প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ১৮ বছরের নিচে বয়সে রোগ নির্ণয় পেয়েছেন। চারটি গ্রামীণ এলাকায় উচ্চ ঝুঁকির ক্লাস্টার পাওয়া গেছে, যেখানে বসবাসকারীদের টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। বিপরীতে, রাজধানী স্টকহোম, গোথেনবার্গ ও মালমোর মতো বড় শহরগুলোতে ঝুঁকির হার ছিল ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কম।
কেন শহরে ঝুঁকি কম
গবেষকরা বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যার কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, শহরাঞ্চলে শিশু বয়সে ভাইরাস সংক্রমণ বেশি দেখা যায়, যা পরবর্তীতে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের মতো অটোইমিউন রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। অপরদিকে, গ্রামাঞ্চলে শিশুরা কীটনাশক বা অ্যালারজেনের মতো পরিবেশগত ঝুঁকিতে বেশি থাকতে পারে, যা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যদিও এগুলো এখনও অনুমানমাত্র, তবে সুইডেনের বিশদ পরিবেশগত তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে ভবিষ্যতে বিষয়গুলো আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
তারা আরও বলেন, "এই ফলাফল সম্পূর্ণ নতুন এবং আমাদের প্রত্যাশার বাইরে। এটি পরিষ্কার যে, টাইপ ১ ডায়াবেটিসের বিস্তারে ভৌগোলিক পার্থক্য রয়েছে এবং জীবনের প্রথম পাঁচ বছরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এখন সময় এসেছে শহর ও গ্রামভিত্তিক জীবনযাত্রা এবং পরিবেশগত উপাদানের প্রভাব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনার।"
এই গবেষণাটি স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে, শিশুর বেড়ে ওঠার স্থান ভবিষ্যতের একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের মতো রোগের ক্ষেত্রে পরিবেশ কতটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য এ ধরনের গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন দরকার আরও গভীর অনুসন্ধান এবং সচেতনতা, যেন আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়।
সূত্র:https://tinyurl.com/4hzubjyb
আফরোজা