
ছবি: প্রতীকী
বর্তমান বিশ্বে কর্পোরেট জগতে দক্ষ মানবসম্পদ খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। অপরদিকে, বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। এই দুই সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম, যা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও একটি কৌশলগত বিনিয়োগ।
বিশ্বের অনেক নামী প্রতিষ্ঠান যেমন গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপল, ইউনিলিভার ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরেই ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামকে প্রাথমিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে। একটি গবেষণা (Glassdoor, 2023) অনুযায়ী, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬০% নতুন নিয়োগ ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম থেকেই আসে। অন্যদিকে, National Association of Colleges and Employers (NACE) এর তথ্যমতে, ৭০% নিয়োগদাতা ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করা প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন গ্র্যাজুয়েট প্রবেশ করলেও তাদের অনেকের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের অনেক নিয়োগকর্তা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্তুষ্ট নন। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন কর্মীদের উপযুক্ত করে তুলতে অতিরিক্ত সময়, প্রশিক্ষণ ও খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইন্টার্নশিপ হতে পারে এক বাস্তবসম্মত সমাধান।
কোম্পানির জন্য ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের প্রধান উপকারিতা:
১. দক্ষ ভবিষ্যৎ কর্মী গড়ে তোলা
ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভবিষ্যতের দক্ষ কর্মী হিসেবে তৈরি করতে পারে।একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টার্নশিপ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের টার্নওভার রেট ৫০% কম (NACE Report, 2023), যা কোম্পানির জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক।
২. নতুন ও সৃজনশীল ধারণা অর্জন
তরুণরা নতুন প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড, এবং উদ্ভাবনী চিন্তায় দক্ষ। Harvard Business Review অনুযায়ী, ৭৮% কোম্পানি মনে করে, ইন্টার্নরা প্রতিষ্ঠানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্ভাবনী চিন্তা আনতে সাহায্য করে।
৩. কম খরচে মানবসম্পদ গঠন
ইন্টার্নদের সাধারণত কম পারিশ্রমিকে কাজ করানো হয়। SHRM-এর তথ্যমতে, একজন ফুল-টাইম কর্মী নিয়োগের তুলনায় ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে কর্মী পাওয়া ৪০% বেশি সাশ্রয়ী।
৪. সহজ ও কার্যকর নিয়োগ প্রক্রিয়া
ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের সুযোগ পায়, ফলে তারা ঝুঁকিমুক্ত নিয়োগ দিতে পারে। ৯০% প্রতিষ্ঠান মনে করে, ইন্টার্নশিপ হলো ট্যালেন্ট হান্টের অন্যতম কার্যকর উপায়।
৫. ব্র্যান্ড ইমেজ ও CSR শক্তিশালী করা
ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম পরিচালনার মাধ্যমে কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি পায় এবং এটি কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (CSR) এর একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. টেকনোলজি ও মার্কেট ট্রেন্ডে আপডেট থাকা
ইন্টার্নরা সাধারণত নতুন টেকনোলজি ও টুলস সম্পর্কে সচেতন থাকে, যা কোম্পানিকে ডিজিটালাইজেশন ও ইনোভেশন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে রাখে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করণীয়:
১. একটি কাঠামোবদ্ধ ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম তৈরি করা: সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব, প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করে ইন্টার্নশিপ পরিচালনা করতে হবে।
2. পেইড ইন্টার্নশিপ চালু করা জরুরি: বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ ইন্টার্নশিপ আনপেইড। তবে NACE Survey অনুযায়ী, উন্নত দেশগুলোতে ৮৫% ইন্টার্নশিপই পেইড, যা শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পখাতের সমন্বয়: বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইন্টার্নশিপ সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
৪. দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা: শুধু কাজ নয়, সফট স্কিল, লিডারশিপ, টিমওয়ার্ক ও টেকনিক্যাল দক্ষতা উন্নয়নেও গুরুত্ব দিতে হবে।
৫.দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থান ভাবনায় ইন্টার্নদের মূল্যায়ন করা: অস্থায়ী না ভেবে, ইন্টার্নদের মধ্যে থেকে ভবিষ্যৎ লিডার খুঁজে বের করতে হবে।
ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম শুধু একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা নয়, বরং এটি একটি স্মার্ট ও কৌশলগত বিনিয়োগ। বাংলাদেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সঠিকভাবে এই প্রোগ্রামগুলো পরিচালনা করে, তবে তারা একদিকে যেমন প্রতিভাবান কর্মী পাবে, অন্যদিকে দেশের তরুণ সমাজও চাকরির বাজারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। দক্ষ মানবসম্পদই একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি, আর ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম হতে পারে সেই উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি।
লেখক: এডটেক উদ্যোক্তা
এম.কে.