ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ

ইফতেখার আহমেদ খান

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১৯ মার্চ ২০২৩

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ

.

পবিত্র রমজান আসছে। বরাবরের মতোই মানুষ উৎকণ্ঠায় দ্রব্যমূল্যের ঊধ্বগতিতে। প্রতিবছর রমজানে সরকারের কঠোর কঠিন নজরদারি থাকা সত্ত্বেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই থাকে। এটি বাংলাদেশের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা। কোনোক্রমেই এই বাস্তবতার নাগপাশ ছিন্ন করতে সক্ষম হয় না দেশের সাধারণ মানুষ। চলমান সময়ে দ্রব্যমূল্য ইতোমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে। এরপরও যদি বৃদ্ধি পায় তবে সেটা জনগণের জন্য বড় বেশি কষ্টদায়ক ব্যাপার হয়ে উঠবে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির একটি উপাদান হলো বণ্টন সংকট। সার্বভৌমসত্তা হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে ৫২ বছর আগে।

সময়ের হিসাবে নেহায়েত কম নয়। এতটা সময় পার হওয়ার পরও স্থিতি এলো না। সাধারণ নাগরিকের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন এটা নয়। এটা নির্দ্বিধায় শোষণ বঞ্চনা। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ১৪-তে কৃষক শ্রমিকের মুক্তির কথা এভাবে বলা হয়েছেÑ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব মেহনতী মানুষকে, কৃষক শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দান করা। সঙ্গে সঙ্গে অনুচ্ছেদ ১৫ এর ধারায় বলা হয়েছে- রাষ্ট্র অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ জনগণের বেঁচে থাকার সামগ্রিক শর্ত নির্মাণে রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। ধারাসমূহ খেয়াল করলে দেখা যায় কৃষক-শ্রমিক এবং অনগ্রসর জনগণের কথা বলা হয়েছে। এখন যদি আমরা মিলিয়ে দেখি দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, নিঃসন্দেহে শহরের মধ্যবিত্ত চাকুরে শ্রেণি, শ্রমিক- কৃষক এবং রাষ্ট্রের অনগ্রসর অংশ তার মানে রাষ্ট্র ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তার শর্ত পূরণ করতে পারছে না। রাষ্ট্রের সুখ সংজ্ঞায়িত করলে সংজ্ঞাটি ব্যাপক কলেবর লাভ করবে। সংকীর্ণভাবে এটা বলা যায় সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মতো মৌলিক প্রয়োজন ন্যূনতম মাত্রায়ও যদি পূরণ হয়, তবে বলা যায়, রাষ্ট্রে সুখ আছে।

জরুরি এই সামান্য সুখটুকু নিশ্চিত করতে না পারলে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যসমূহ কোন পর্যায়ে তা অনুধাবন করা যায়। ক্রেতা-বিক্রেতা, খুচরা-পাইকারি-মজুতদারি সকল পর্যায়ের সঙ্গে প্রকল্প নিয়ন্ত্রণে আলোচনা করা হচ্ছে। প্রতিটি পর্যায়ই যার যার অবস্থান থেকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার রেখে বয়ান করছে। সব পর্যায়ের সঙ্গে অনুসন্ধান চালিয়েও কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছে না। বিষয়টি এমনÑ একদল ছেলেকে একটি মাঠে ছেড়ে দেওয়া হলো। ছেলেগুলো সেখানে খেলছে কোলাহল করছে এবং একসময় বড়দের মধ্য থেকে ইশারায় বিশৃঙ্খলা করে ফেলেছে। বিশৃঙ্খলা কে করেছে তার অনুসন্ধান শুরু হলো। সারাদিন অনুসন্ধান করেও সঠিক চিত্র পাওয়া গেল না। কারণ বড়দের মধ্য হতে যিনি ইশারা করেছেন অনুসন্ধানী দল তার কাছে পৌঁছতেই পারেনি। ঠিক তেমনি দ্রব্যমূল্য পরিবীক্ষণের সরকারের নির্দিষ্ট দপ্তর রয়েছে। সেই দপ্তর উদ্দিষ্ট ঘটনার কারণ বের করবে নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কার্য বিন্যাসে। এটি আমাদের দেশের বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব। কেননা আমাদের প্রশাসনযন্ত্রের সুগঠিত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেনি। প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও বাংলাদেশের সুশাসন এখনও প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি। এখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অসম বণ্টন এক নিয়ত বাস্তবতা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম ভাগ পায় না।

দেখতে পাওয়া যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত নাগরিক রাষ্ট্রীয় সম্পদের চুলচেরা ভাগ পায়। অপরদিকে যে জনতার দুর্বার শ্রমে রাষ্ট্রীয় কোষাগার পূর্ণ হয়, সেই জনতা সেই কোষাগার থেকে কোনো বিনিময় পায় না। আয়ের সীমাহীন বৈষম্য, ধনী-গরিবের আকাশচুম্বী ব্যবধান, সুযোগের ব্যাপক প্রায় তারতম্য, দুর্নীতির উল্লম্ফন ধারাবাহিকতা, নির্মম দলীয়করণ শাসনতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় একটি বড় মাপের বণ্টন সংকটের উদ্ভব ঘটিয়েছে। এসব উপাদানের সগৌরব উপস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলনীতিসমূহকে চ্যালেঞ্জ করছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায় অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সামরিক শাসন দীর্ঘদিন বলবৎ থাকায় নাগরিকবৃন্দ নিয়মতান্ত্রিক শাসন অনিয়মতান্ত্রিক শাসন সম্বন্ধে ধারণার অধিকারী হয় না। স্বাধীনতা অব্যবহিতকাল ১৯৭৫ সাল থেকেই বাংলাদেশে অনিয়মতান্ত্রিক শাসন জারি হয় এবং এর ভয়ংকর প্রভাব বলয় তৈরি হয় যার কারণে ১৯৯০ পরবর্তী সময় থেকে পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও শাসনতান্ত্রিক বিন্যাসটি জনমুখী করা সম্ভব হয়নি। বাস্তবিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের বাস্তবতায় প্রশাসনিক জটিলতাসহ আরও নানা কারণে সরকার যথেষ্ট মাত্রায় জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে না। অর্থাৎ সরকার জনগণের মাঝে কার্যকর অর্থবহ সংযোগ প্রতিষ্ঠা পায় না। সরকারের সকল উন্নয়ন উদ্যোগ, নীতি এবং এসব বাস্তবায়নে জন-উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থাকেই বলা হয় জনগণের মাঝে সরকারের অনুপ্রবেশ প্রায় নেই। জনগণের সঙ্গে সরকারের অনুপ্রবেশ নেই বিধায় জন-অভিপ্রায় সরকার সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না।

উদাহরণ হিসেবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা বলা যায়। জনগণের ইচ্ছা হলো দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে কিংবা ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকুক। কিন্তু সরকার তা অনুধাবন করতে পারছে না তেমনভাবে। অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির চর্চায় নেতৃত্ব শ্রেণির রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা ভোগন্যায্য সমাজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে না। দুর্বৃত্তায়িত নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ জনগণ আগ্রহী হয় না। ফলে প্রতিবাদ জানানোর মতো যথেষ্ট তথ্যপ্রাপ্তি ঘটলেও জন-অংশগ্রহণের ভিত্তিতে শাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না। সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তীব্রভাবে প্রশাসনিক জবাবদিহির আওতায় ফেলা যায়। তবে সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

লেখক : উন্নয়নকর্মী, কথাশিল্প

[email protected]

×