
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে এখন এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন, যার কোনো না কোনো সদস্য প্রবাসে নেই। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, কিংবা আমেরিকা—যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই ছুটে গেছে আমাদের তরুণরা। কারণ একটাই—স্বপ্ন। ভালো জীবন, পরিবারের উন্নয়ন, স্বজনের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্নের পেছনে যে কঠিন বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে, তা অনেক সময় আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আমরা দেখি রঙিন ফেসবুক পোস্ট, বিদেশি নোট, দামি মোবাইল; দেখি না ক্লান্ত হাত, নিঃসঙ্গ রাত আর না বলা কান্না।
প্রবাস মানে শুধুই টাকা নয়
আমাদের সমাজে ‘প্রবাস’ শব্দটার সঙ্গে অর্থনীতিকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যেন বিদেশ মানেই অগাধ টাকা। অথচ বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ প্রবাসীই শ্রমজীবী মানুষ। তারা ১২-১৪ ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনি করে দিনে মাত্র ৮০০-১২০০ টাকা আয় করে। তাও আবার অনেক সময় বেতন ঠিকমতো মেলে না। অথচ দেশে পরিবারের প্রত্যাশার পাহাড়। কেউ ভাবেন না, একজন মানুষ দিনের পর দিন পরিবার থেকে দূরে থেকে কেমনভাবে বাঁচে।
রোজগারের চেয়ে আত্মত্যাগ অনেক বেশি
প্রবাসে যেতে হলে প্রথমেই দিতে হয় বিশাল অঙ্কের টাকা। অনেকেই জমি বিক্রি করে, ঋণ করে, সুদে টাকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। যাওয়ার পর দেখা যায় প্রতিশ্রুত কাজ নেই, মজুরি কম, থাকা-খাওয়ার অবস্থা শোচনীয়। এরপর শুরু হয় ‘টাকা পাঠাও’ চাপ। দেশে থাকা পরিবার ভাবে ছেলে বিদেশে মানে টাকা বর্ষণ। ফলে নিজের প্রয়োজনকে দূরে সরিয়ে রেখে পরিবার চালাতে হয়।
একজন প্রবাসী নিজের জামা কিনতে দু’বার ভাবে, কিন্তু পরিবারকে মোবাইল বা ফ্রিজ কিনে দিতে পিছপা হয় না। এটাই ভালোবাসা, আবার এটাই অনেক সময় আত্মত্যাগের চরম রূপ।
পরিবার থেকে দূরত্ব ও মানসিক যন্ত্রণা
প্রবাসী জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো পরিবার থেকে দূরে থাকা। ঈদ, পূজা, বিয়ে, জন্মদিন—সব উৎসবই কাটে ফোনের এপাশে দাঁড়িয়ে। মা-বাবার অসুস্থতা কিংবা সন্তানের প্রথম হাঁটা দেখা হয় না অনেক সময়। এসব ঘটনা প্রবাসীদের মানসিকভাবে কুরে কুরে খায়। দিনশেষে তারা একাকী হয়ে ওঠে। কারো কারো মধ্যে বিষণ্নতা, হতাশা এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত তৈরি হয়।
প্রতারণা ও নিপীড়নের শিকার
ভিসা নিয়ে হাজারো প্রতারণা চলে প্রবাসজীবনের শুরুতেই। ভিন্ন ভিন্ন দালালের মাধ্যমে অনেকে যান, অথচ গন্তব্যে পৌঁছে দেখা যায় কোম্পানি অস্তিত্বহীন, কাজ নেই বা চুক্তি ভিন্ন। এরপর যাদের কাগজপত্র ঠিক নেই, তারা হয়ে যান ‘অবৈধ’। অবৈধ অবস্থায় কাজ করলে মালিকরা শোষণ করে, সময়মতো বেতন দেয় না, কখনো পুলিশ ধরে ডিপোর্ট করে দেয়। এই অবস্থা একজন মানুষের আত্মসম্মান চূর্ণ করে দেয়।
সামাজিক চাপে ভেঙে পড়া প্রবাসী
আজকের যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিযোগিতার ঝড়। অনেকে বিদেশে থেকেও সুখের ছবি দেন, যেন পরিবার খুশি থাকে। কিন্তু এই ‘ভুল সুখ’ অনেক সময় নিজেদের ওপরই চাপ তৈরি করে। আবার দেশে ফিরলে সমাজ বলে, “বিদেশ গিয়েও কিছু করতে পারলে না!”—এই দৃষ্টিভঙ্গি একজন প্রবাসীকে সমাজে একপ্রকার বর্জনীয় করে তোলে। অথচ আমরা জানি না তার জীবনে কী যুদ্ধ চলে।
প্রবাসেও মানুষ, তাদেরও অনুভূতি আছে
আমরা প্রবাসীদের শুধু টাকা পাঠানোর মেশিন হিসেবে দেখি। অথচ তারাও মানুষ, তাদেরও অনুভূতি আছে, ভালোবাসা আছে, স্বপ্ন আছে। তারা চায় কেউ একটু পাশে দাঁড়াক, রাষ্ট্র যেন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, দূতাবাস যেন তার অভিযোগ শোনে, সমাজ যেন তাকে শ্রদ্ধা করে।
সমাধান কী হতে পারে?
প্রবাসী সংকট সমাধানে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। দালাল চক্র নির্মূল করে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্য নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, আইনি সহায়তা ও হটলাইন চালু করতে হবে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের পুনর্বাসনের সুযোগ দিতে হবে—যাতে তারা দেশের অর্থনীতিতে অংশ নিতে পারেন, সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেন।
শেষ কথা
প্রবাসী জীবন স্বপ্নের, কিন্তু সেই স্বপ্নের পথটা খুব মসৃণ নয়। ঘাম, রক্ত, কান্না—সবকিছু মিশে আছে তাতে। আমাদের উচিত এই জীবনকে সম্মান করা, সহমর্মিতা দেখানো। কারণ প্রবাসীরা শুধু টাকা পাঠায় না—তারা তাদের যৌবন, স্বপ্ন আর হাসিমুখ রেখে আসে বিদেশের অচেনা মাটিতে।
লেখক: শরিফুল খান প্লাবন
প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
রাজু