ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

মাইলস্টোন-স্কুল ট্র্যাজেডি

‘বন্ধু, আমি জানতাম তুমি আসবে’

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

প্রকাশিত: ১৯:২০, ২৪ জুলাই ২০২৫

‘বন্ধু, আমি জানতাম তুমি আসবে’

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। হঠাৎ বিস্ফোরণ। মুহূর্তেই ধসে পড়ে একাংশ, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় শিশুকণ্ঠে মুখরিত ক্লাসরুম অসংখ্য শিশু প্রাণ হারায়, আরও শতাধিক আহত। যাদের অনেকে এখনো হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। আমার দুই সন্তান, ক্লাস ফোরে পড়ে। যখন এই খবর পেলাম, পিতৃত্ব যেন বোবা হয়ে গেল। চোখের সামনে যেন আমাদের সন্তানের মুখ ভেসে উঠলো বারবার মৃতদেহের মুখ, কষ্টে চিৎকার করা মায়ের আর্তনাদ, আর সেই ছাত্রটির শেষ কথা হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয় যে ‘আমি জানতাম তুমি আসবে বন্ধু’ দুর্ঘটনার সময় এক ছাত্র তার আহত বন্ধুকে ক্লাসরুম থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল ফায়ার ব্রিগেডের অফিসার তাকে বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘এর কোনো মূল্য নেই সে মারা গেছে’। কিন্তু সেই ছাত্র কাঁধে ভর করে ফিরিয়ে আনল তার বন্ধুকে। ফায়ার ব্রিগেডের সেই অফিসার হতাশ গলায় বললেন, ‘দেখেছো? সে তো মরেই গেছে।’ কিন্তু ছাত্রটি থেমে থাকেনি, সে বলল,
‘না স্যার, এটা মূল্যহীন ছিল না। যখন আমি তার কাছে পৌঁছাই, তখন সে জীবিত ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, আর বলল,
‘আমি জানতাম তুমি আসবে বন্ধু’
এই একটি সংলাপ, আজকের বাংলাদেশকে ব্যাখ্যা করে। আমরা জানি না কোথায় আশ্রয় নেব, কে আসবে আমাদের বাঁচাতে। তবে অন্তত জানি- কেউ একজন আসবেই। ঠিক সময়মতো, হয়তো না– বাঁচাতে পারলেও আমাদের পাশে থাকবে, চোখে চোখ রেখে বলবে, ‘আমি আছি’।
বার্ন ইনস্টিটিউটে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক মা, তাঁর ১৫ বছর বয়সী মেয়ে মারা গেছে। আর ৯ বছরের ছেলেটি, যাকে নিয়ে তিনি সকাল থেকে একটাই প্রশ্ন করছেন সবার কাছে ‘বাচ্চাটার শ্বাস আছে তো?’ যখন কেউ হ্যাঁ বলে, তখনই তিনি খুশি হয়ে যান। মাঝে মাঝে বলেন, ‘ওর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, প্লিজ কম্বলটা গায়ে ভালো করে দিন।’ এই কথার কোনো উত্তর দেওয়া যায় না। একটা মায়ের এই মর্মবেদনার মুখোমুখি হয়ে কেউ কি বলতে পারে, ‘সান্ত্বনা নিন’? আরেকজন মা, মাহতাবের মা- শুধু সন্তানকে একবার দেখতে চেয়েছেন। চোখে বিস্ময়, শঙ্কা আর স্বপ্নভঙ্গের ভয়। অনেক মায়ের মতো তারও একমাত্র সন্তান, যার জন্য তিনি শ্বাস নিচ্ছেন। এখানে যারা আছেন, তাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ‘জীবিত আছে তো?’ একটা দেশে যখন মানুষ শুধু জীবিত থাকার প্রমাণ চায়, তখন বুঝতে হবে সেই রাষ্ট্র এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। 
আমরা এখন এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাস করছি, যেখানে জনগণের নয়, বরং ক্ষমতালোভী একটি গোষ্ঠীর ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয়। সরকার কি এই ট্র্যাজেডির দায় এড়াতে পারেন? যদি আগে থেকে জানাজানি ছিল, কেন সতর্কতা নেওয়া হয়নি? কেন শিশুরা নিহত হলো? কেন এই রক্ত, এই কান্না, এই স্বপ্নের অপমৃত্যু? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। কিন্তু আমরা জানি- এই ষড়যন্ত্র সফল হবে না। ইনশাআল্লাহ এই রাষ্ট্র আবার জাগবে, আবার বলবে, ‘আমরা পরাজিত হব না।’ বন্ধু শুধু পাশে থাকলে নয়, বিপদে ছুটে এলে তা বন্ধুত্ব হয়। আজ যারা ক্ষমতায় আছে, তারা কি আমাদের বন্ধু? যারা রাস্তায় রক্ত ফেললো, যারা স্কুলে আগুন ধরালো, যারা হাসপাতালে প্রবেশাধিকার বন্ধ করল, তারা কারা? এরা বন্ধুর মুখোশ পরে শত্রুতা করছে।
জাতির এই শোকের সময়েও রাজনৈতিক প্রশ্ন এড়ানো যায় না। আজ যারা রাষ্ট্রক্ষমতায়, যারা নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবে দাবি করেন- তাদের আচরণই প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নিয়ে চলছে আলোচনা, গবেষণা, তদন্ত ফেসবুক থেকে শুরু করে সকল সোশ্যাল মিডিয়াতে।
এই ট্র্যাজেডি শুধু শোক নয়, এটি প্রতিবাদের একটি ডাক। নিরাপত্তা সংস্কার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা শিশুদের জন্য, জাতির জন্য একটি আনুষ্ঠানিক স্মরণ। সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা- জনগণের একতা, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, এসবই আমাদের মূল শক্তি। আজ যদি আমরা চুপ থাকি, কাল আর কিছু বলার সুযোগ থাকবে না।
বন্ধু তখনো পাশে থাকবে না, কেউ তখন বলবে না, ‘আমি জানতাম তুমি আসবে’ আজ সেই সময়, যখন সবাইকে বন্ধু হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুদের রক্ষা করতে, রাষ্ট্রকে বাঁচাতে, মানুষকে বাঁচাতে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও গবেষণা ফেলো, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি

প্যানেল/মো.

×