
.
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানকার একজন বিশেষজ্ঞকে দেখাবেন এক আত্মীয়া। থাকেন রাজবাড়ীতে। হাঁটু এবং কোমরের ব্যথায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। ঢাকার বাইরে থেকে অনেক চেষ্টা করেও ডাক্তারের সিরিয়াল নিতে পারেননি। অগত্যা অনুরোধ করলেন তাকে সহযোগিতা করার জন্য। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ওই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাতে সপ্তাহে মাত্র একটি দিন (শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত) মোবাইলফোন ৩০ মিনিট খোলা থাকে। ওই সময়ের মধ্যে যাদের নাম নেওয়া হয় সারা সপ্তাহ তাদেরকেই দেখে থাকেন সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।
সিরিয়াল দেওয়ার জন্য যে নম্বর সেটি টানা দুই সপ্তাহ বন্ধ পেলাম। এই লোক সেই লোক ধরেও কোনোভাবেই সিরিয়াল পাওয়া গেল না। অগত্যা সশরীরে সেই হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হলাম। প্রশাসনের একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘উনার সিরিয়াল পাইতে ঠেলা আছে। আমরা স্টাফ হয়েও আত্মীয়স্বজনদের দেখাতে পারি না।’ কী ভয়াবহ কথা!
এরপর গেলাম তিনি (বিশেষজ্ঞ ডাক্তার) যেখানে বসেন সেই ফ্লোরে। একজন নারী স্টাফের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘স্যার বিদেশে আছেন। কবে আসবেন জানি না।’ বললাম, ‘সিরিয়ালের জন্য হাসপাতালের ওয়েবসাইটে একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি যিনি করেন তিনি কোথায় বসেন? ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ঠিক নাই। এখানে থেকেও করেন, অন্য জায়গা থেকেও করেন। স্যার দেশে থাকলে তিনি হাসপাতালে আসেন। না হলে আসেন না। এখন স্যার নাই, সে-ও নাই।’ তার (ডাক্তার সাহেবের অ্যাসিস্টেন্ট) পারসোনাল নম্বরটি চেয়েও কোনোভাবে পেলাম না। নিচে রিসিপশনে গিয়ে ডাক্তার সাহেবের একটি ভিজিটিং কার্ড নিলাম। তাতে সেই নম্বরটিই দেখলাম, যেটি গত দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ।
কৌতূহলবশত তৃতীয় শুক্রবার সকাল ১০টা ১ মিনিট থেকে সিরিয়ালের জন্য ফোন দেওয়া শুরু করি। এবার মোবাইল খোলা পাওয়া গেল বটে; কিন্তু প্রতিবারই জবাব আসছে, আপনি যে নম্বরে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। সকাল সাড়ে ১০টা বাজতেই সুইচড অফ।
অর্থাৎ এই মুহূর্তে আপনার কাক্সিক্ষত নম্বরটিতে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন এলো, ওই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের রোগী আসলে কারা? কারাইবা সেই লটারির মতো আচমকা ফোনকলে সংযোগ পেয়ে যান! নাকি পুরোটাই ভাঁওতাবাজি? সাতদিন অপেক্ষার পর দূর-দূরান্ত থেকে ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মতো যারা ফোনকলে অংশ নেন তারা তো আমাদেরই কারও না কারও আপনজন। টাকা দিয়েই তো তারা ডাক্তার দেখাবেন। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে কেন এতো ভোগান্তি?
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতিবছর পাঁচ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। আর সেই বাবদ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। যার বড় একটি অংশই যায় ভারতে। সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মতে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অদক্ষতা ও আস্থার সংকটে বিদেশে যাচ্ছেন রোগীরা। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ছাত্র-শিক্ষক ও শ্রমিকরা বেশি যান ভারতে। ডাক্তার ও নার্সিং ভালো পান বলেই তারা সেখানে যান। প্রশ্ন উঠতেই পারেÑ বাংলাদেশে তারা কেন সেটা পান না? বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে নাগরিকদের নিজের পকেট থেকে। দুঃখজনক হলো তাদেরই বিশাল একটি অংশ বঞ্চিত হন দেশে সুচিকিৎসা কিংবা ভালো সেবা থেকে।
গরিব রোগীদের কথা চিন্তা করেই ‘সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা অফিস সময়ের পর নিজ নিজ হাসপাতালে চেম্বার করবেন’Ñ এমন একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। অর্থাৎ বিকেলে বা সন্ধ্যায় যেসব সরকারি চিকিৎসক বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল বা ওষুধের দোকানে রোগী দেখতেন সেসব চিকিৎসক ওই সময় রোগী দেখবেন নিজের হাসপাতালে। অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য থাকাকালীন সেখানে ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ চালু করেছিলেন। নিয়ম করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের বিকেলে হাসপাতালে ব্যক্তিগত চেম্বারের মতো রোগী দেখবেন। ব্যক্তিগত চেম্বারে সাধারণত ফি নির্ধারণ করে থাকেন চিকিৎসক নিজে। কিন্তু বিএসএমএমইউতে ফি নির্ধারণ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। রোগীপ্রতি ফি নির্ধারিত হয় ২০০ টাকা। এর মধ্যে ১৩৫ টাকা পান চিকিৎসক। বাকি ৬৫ টাকা কর্মচারীরা। এই প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছেন রোগীরা। মজার বিষয় হচ্ছে, বিএসএমএমইউর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যখন ফার্মগেট, গ্রিন রোড, এলিফ্যান্ট রোডসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালে রোগী দেখেন তখন তাদের ফি দিতে হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। বিএসএমএমইউতে চালুর পর অনেকেই এর বিরোধিতা ও সমালোচনা করেছিলেন। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি গ্রহণ করে ‘বারডেম’।
এমন অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন যারা নাম, যশ-খ্যাতি অর্জনের পর বছরের বেশিরভাগ সময়ই বিদেশে সভা-সেমিনার, ভ্রমণে কাটিয়ে দেন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মেধাবীরাই মূলত সুযোগ পান দেশের নামি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার। ডাক্তার হয়ে কারও কারও মনে থেকে যায় গ্রামের সেই অসহায় মানুষগুলোর মুখচ্ছবি যারা ভালো চিকিৎসাসেবা কখনো পায়নি। আরেকটি শ্রেণি আছে যারা অচ্ছুতের মতো। তাদের দেখা পাওয়া অনেক সাধারণ রোগীদের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার! একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সেবা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন অনেক রোগী। নিজ হাসপাতালে চেম্বার করার আইনের মতো যদি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেশেই বাধ্যতামূলক প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা ও সাক্ষাতের বিষয়টি সহজ করা যায় তবে সাধারণ রোগীরা অনেক বেশি উপকার পেতে পারেন।
লেখক : সাংবাদিক