ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫, ৯ শ্রাবণ ১৪৩২

মাইলস্টোনের সাহসী শিক্ষিকা মাহেরীনের সমাধিতে বিমান বাহিনীর শ্রদ্ধা

তাহমিন হক ববী,নীলফামারী

প্রকাশিত: ০০:৩১, ২৪ জুলাই ২০২৫

মাইলস্টোনের সাহসী শিক্ষিকা মাহেরীনের সমাধিতে বিমান বাহিনীর শ্রদ্ধা

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী।

বুধবার (২৩ জুলাই) রাতে নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার বগুলাগাড়ী গ্রামে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনের পক্ষ থেকে শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন মমিনুল ইসলাম, ওআইসি আনিছুজ্জামান,  ওসি সি এন্ড এম ইউনিট লালমনিরহাট, জলঢাকা থানা অফিসার ইনচার্জ ওসি আরজু মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেনসহ বিমান বাহিনীর জেসিও পদবির সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এসময় মরহুমা শিক্ষিকা স্বামী মনছুর আলী হেলাল, দুই সন্তান আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ও আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। বিমান বাহিনীর প্রতিনিধি দল মরহুমার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। 

মানবিকতা, সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরী। নিজের জীবন উৎসর্গ করে যেভাবে তিনি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রক্ষা করেছেন, তা চিরকাল সবার হৃদয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এর আগে সকাল ১১টায় সাহসী শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরীর কবরে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নীলফামারীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান ও পুলিশ সুপার এ. এফ. এম তারিক হোসেন খান। 

এসময় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, "মাহরিন চৌধুরীর সাহসিকতা আমাদের গর্বিত করেছে। তাঁর আত্মত্যাগ এই প্রজন্মের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।"

পুলিশ সুপার এ. এফ. এম তারিক হোসেন খান বলেন, "তিনি ছিলেন মানবিক, সাহসী ও অনুকরণীয় একজন শিক্ষক। তাঁর আত্মত্যাগ সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।"

এসময় উপস্থিত ছিলেন জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন, জলঢাকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরজু মো. সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ।

গত সোমবার (২১ জুলাই দুপুরে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা করেন। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকাল ৪টায়  তাঁকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয় গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে।

সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ও সম্মাননা দেওয়ার দাবি:- 
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলাবাসীর পক্ষে  শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরীর সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ও সম্মাননা দেওয়ার দাবি তোলা হয়। উপজেলার সর্বস্তরের মানুষজন এ দাবি তুলেছেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে এমন দাবি তুলে টাঙানো হয়।

বিশিষ্ট লেখক ও আলোচক ফাহাম আব্দুস সালাম ছাত্রদেরকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিহত হওয়া শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরীকে নিয়ে একটি আবেগঘন মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেছেন,'বাংলাদেশে সত্যিকারের বীরত্বের ঘটনা কম ঘটে। একজন মহিলা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এতগুলো শিশুকে উদ্ধার করেছেন - এর সমতুল্য ঘটনা সম্ভবত আমি আমার জীবনে শুনি নাই বাংলাদেশে।' 

বুধবার (২৩ জুলাই) নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজের একটি পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তিনি।ফাহাম আরও লিখেছেন, 'এমন মহীয়সী নারীকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ও সম্মাননা দেওয়া উচিত। আপনারা যারা সরকারে আছেন অবশ্যই বিবেচনা করবেন। মানুষের সাহস কোনোদিনে ইউনিফর্ম পরে না। আমরা এই মহিলার সাহসকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে চাই। আসুন আমরা এই মহান মহিলার জন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলি।'

জলঢাকার বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আগামী ২৮ জুলাই। ওই সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা ছিল শিক্ষক মেহেরিনের। প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই তিনি লাশ হয়ে ফিরলেন।

পারিবারিক সূত্র জানায়, মরহুম মোহিতুর রহমান চৌধুরী ও ছাবেরা চৌধুরী দম্পতির বড় সন্তান মাহেরীন চৌধুরী। তারা দুই ভাই ও দুই বোন। সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এর মা মরহুম জাহানারা খাতুন ও মাহেরিনের দাদী মরহুম রওশনারা বেগম ছিলেন আপন দুই বোন। তার দাদা মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরী ছিলেন এলাকার সুনামধন্য জমিদার। মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরীর পিতা মাহফুজার রহমান চৌধুরী বগুলাগাড়ী স্কুলটি নির্মাণ করেছিলেন ১৮১৯ সালে। ১৯৭০ সালে তা বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ নামে স্থাপিত করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী।শিক্ষাজীবন শেষে মেহেরিন ২০০২ সালে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক হিসেবে যোগ দেন।

২০০৮ সালে শরীয়তপুর নড়িয়া উপজেলার চর আত্রাই গ্রামের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার মনছুর হেলালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের রয়েছে দুই ছেলে সন্তান। এর মধ্যে বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ও-লেভেল শেষ করেছে। আর ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী ও-লেভেল পরীক্ষা দেবে। মাহেরীনের বাবা মোহিতুর রহমান চৌধুরী ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ও মা ছাবেরা চৌধুরী ২০২০ সালের ৩০ জুন মারা যান।

সূত্র আরো জানায়, মাহেরীনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ৬ জুন। তিনি ১৯৯৫ সালে ঢাকার শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও ১৯৯৭ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিতুমীর কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন।

মাহেরীন চৌধুরী শিকতার চাকরি জীবনে সবচেয়ে বেশী সময় পার করেছে নীলফামারীর জলঢাকায়। এরপর চলে যান ঢাকায়। যোগদান করেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি স্কুলের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর(৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর) সিনিয়র শিক্ষিকা ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন।

বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মহুবর রহমান বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল এডহক কমিটির সভাপতি হন মাহেরীন। তিনি ২২ জুন প্রতিষ্ঠানে এসে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের দিকনির্দেশনা দেন। ২৮ জুলাই অর্ধবার্ষিকী পরীার ফল প্রকাশ ও অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সোমবার (২১ জুলাই) বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে দুপুর ১২টার দিকে মুঠোফোনে আমার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়।

উল্লেখ যে, মঙ্গলবার(২২ জুলাই) বিকাল ৪টায় নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে মাহেরীন চৌধুরীকে দাফন করা হয়। এর আগে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গজল আজম জামে মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

Mily

×