ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

রিমঝিম বরষায়...

প্রকাশিত: ১৮:১৬, ১০ জুলাই ২০২৫

রিমঝিম বরষায়...

এই বর্ষায় বাংলাদেশ
দেলোয়ার হোসেন

কালের প্রবাহে ফিরে এসেছে রূপময় ঋতু বর্ষা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আষাঢ় কবিতায় আহ্বান করেছেন, ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহরে। কবি গুরুর এই একটি লাইন শুনলেই আমাদের মনে তীব্র আনন্দ, ব্যথা অনুভব হয়। কেন যে এমন হয় তাও সঠিক উত্তর দিতে পারিনা। প্রকৃতির গায়ে নব যৌবনের মুখর গানের উচ্ছ্বাস। নব ধারা জলে স্নান করে তপ্ত দেহ শীতল করার আহ্বান। খরতাপের ধুসর নাগরিক জীবন প্রাণের স্পন্দন জাগায় বর্ষা। টলটল স্বচ্ছ জলের গল্প  চলে দুমাস। গ্রীষ্মের ধুলোমলিন জীর্ণতাকে ধুয়ে ফেলে গাঢ় সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির সাজে পূর্ণতা। তাই বর্ষার প্রারম্ভেই স্বপ্নবিষ্টা এক মোহমুগ্ধতা। রিমঝিম বৃষ্টি বা কখনো মুষল ধারে ভারি বৃষ্টি বর্ষণ হয়। বর্ষাকালে জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়। ফলে চারদিক শুরু হয়ে যায় বৃষ্টি উৎসব। আমাদের পরিবেশে রূপ নেয় চির সবুজের আভরণ। কদম, বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে মানব হৃদয়। শুভ্রজল গায়ে মেখে নেচে ওঠে বৃষ্টি বিলাসীরা। বর্ষার প্রকৃতির শোভা কদম ফুল। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটন্ত কদম ফুল। প্রকৃতিতে মন ভোলানো সৌর্ন্দয। কদম ফুলের সতেজ নির্মল মোহনীয় ঘ্রাণ। প্রকৃতি প্রেমীসহ সবার মনে সৃষ্টি করে ভিন্ন এক সম্মোহনী অনুভূতি। কদম তার অনুষঙ্গ নিয়ে মিথ। বর্ষার প্রথম কদম ফুল যদি প্রেমিক তার প্রেমিকাকে  উপহার দেয় তাহলে তার সম্পর্ক হয় বিষাদমাখা। কাজেই এই ফুল কেউ কাউকে দেয় না।
 শহরের খুব কম মানুষের সঙ্গে চাতক-চাতকীর পরিচয় আছে। তবে স্বপ্ন জাগানো গল্প সবাই জানে। না দেখা পাখির সম্পর্কে। পিপাসায় বুক ফেটে যেতে চায় চাতকে। দরকার ঠান্ডা জল। চারদিক কত হৃদ দীঘি সাগর। কত নদী  সরোবর কিন্তু কবি রামনিধি প্রশ্নছুড়ে মেরেছেন, কিবা ফল চাতক-চাতকীর। চাতক-চাতকীর পিপাসা মিটেনা পদ্ম দীঘির জলে কিংবা ঝর্না ধারায় নদীর স্রোতে বরের টলমল পানিতে। তার মেঘগলা ঠান্ডা জল। চাতক-চাতকী ডাকে ঠান্ডা জল দাও, কালো মেঘ জল দাও। তোমার ধারাজল ছাড়া কিছুতেই পিপাসা মিটে না। একসময় নীল আকাশের কালো মেঘ গলে বৃষ্টি নামে নূপুরের ধ্বনিতে। আকাশ থেকে রূপোর রেখা মতো নেমে আসা বৃষ্টি জল পান করে পিপাসা মিটে চাতক-চাতকীর। আর কোনো জলে ওই নদীর, দীঘির, ঝর্নার, সাগরের, সরোবরের জলে মিটে না পিপাসা তাদের। রূপসী বাংলার কবি জীবনান্দ দাস তাই তো বলেছেন এই জল ভালো লাগে, বৃষ্টির রূপালী জল কতদিন এসে । ধুয়েছে আমার দেহ-বুলিয়ে দিয়েছে চুল-চোখের উপরে। কার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে খেলিয়েছে আবেগের ভরে। বর্ষা আমাদের মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। পুরোনো জঞ্জাল ধুয়েমুছে আমরাও জেগে উঠি প্রাণ চাঞ্চল্য।

এমন বর্ষা চাই না
সৌরভ দুর্জয়

আজকের বৃষ্টিটা একটু অন্য রকম। আষাঢ়ের কৃষ্ণপক্ষের রাত তবুও আকাশের বুকে জ্বলছে লেলিহান শিখা। চিৎকার করছে খ্যাপা বজ্র নিনাদ। বৃষ্টির পানি কোন স্বস্তি দিচ্ছে না। ফুটছে স্ফুটনাঙ্ক তাপমাত্রায়। ব্যারোমিটারের পারদ ঊর্ধ্বমুখী। রাজপথটুকু সাহারা মরুভূমি। পুলিশ, বিজিবির সশস্ত্র পাহারা। শুধু অ্যাম্বুলেন্সগুলো বোবা হয়ে গেছে। হর্নের তার অচল হয়ে আছে। ধীরগতিতে পুলিশ প্রহরায় বের হয়ে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে। মাকে নিয়ে পারুল দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটে। সাটার বন্ধ একটা ঔষধের দোকানের সামনে। মাথাটা রক্ষা হলেও সারা শরীর ভিজে গেছে। পোকা মাকড় পা দিয়ে বেয়ে উঠছে। ক্লান্ত শরীরে অতি সহজে মশায় রক্ত খেয়ে যাচ্ছে। সে দিকে খেয়াল নেই পারুলের। তাঁর তীক্ষè দৃষ্টির লক্ষ্যবস্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেট। কখন বের হবে  অনাকাক্সিক্ষত অ্যাম্বুলেন্স। সেই বিকেল ৪টা থেকে দাঁড়িয়ে আছে। এখন রাত দুইটা বাজে তবুও কোন খোঁজ নেই  অনাকাঙ্ক্ষিত অপয়া অ্যাম্বুলেন্সের। কখন বের হবে  পলাশ। বৃষ্টি নামলে পলাশ কবি হয়ে যেতো। ভুলে যেতো জগৎ সংসার। এক দৃষ্টিতে জানালা খুলে তাকিয়ে থাকতো বৃষ্টির দিকে। আনমনে দেখতো বৃষ্টির নৃত্য। গুনতো ছন্দ মাত্রা। ভিজে যেতো টেবিলের বই। খাটের চাদর। ভেসে যেতো রুমের ফ্লোর। সে দিকে ওর কোন খেয়াল থাকতো না। শুধু কাব্যিক চোখে দেখতো বৃষ্টি। লিখতো কবিতা। মাঝে মাঝে চলে যেতো ছাদে। ঘণ্টাখানেক ভিজে এসে বসে থাকতো ঘরে। এক সময় ছেলের পাগলামি থামাতে বাবা মার প্রেসানির শেষ ছিলো না। বকাঝকা করতো। কাজ হতো না। অসুস্থ হলে ডাক্তারকে দিয়ে ভয় দেখাতো ইনজেকশন দেওয়ার। শুনে পলাশ শুধু হাসতো। নর্থ সাউথে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ওকে আর কেউ বাধা দেয় না। বাধা দিবেই বা কেন। বৃষ্টিতে ভেজা ছাড়া বাবা মার সব কথা মেনে চলে। মন দিয়ে লেখা পড়া করে। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। করে না কারো ক্ষতি। রুক্ষ দৃষ্টি দেয় না কারো প্রতি। যেন বৃষ্টিতে ভেজা নিরীহ পলাশ ফুল একটি। লিফটের সামনে লোকজন বেশি দেখলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় সাত তলায়। ডোম কি ওকে চিনতো?  জানতো না কী পলাশ একজন আত্মত্যাগী মানুষ। বৃষ্টির প্রেমে পাগল হওয়া কবি। তাই বুঝি পলাশের সিরিয়ালটা পিছনে রেখেছে। পলাশ কি বিপ্লবী চোখে বিদ্রোহী বৃষ্টি দেখছে? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পারুল কেঁদে উঠলো। শোকার্ত গলায় বলে উঠলো : ভাইটা আমার অনেক ক্ষুধার্ত। দুপুরে কিছুই খায়নি। এক আন্টি ডিম খিচুড়ি দিয়েছিল। প্যাকেটটা খুলতেই বাবার অধীনস্থ এক এসআইর নির্দেশে ওদের পাঁচ বন্ধুর বুক ঝাঁঝরা করে দেয় জনগণের টাকায় কেনা নিষ্ঠুর বুলেট।  ওরা এখন ঘুমিয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। শবদেহ নিতে এসে পারুল ও তার মা দাঁড়িয়ে আছে ১০ ঘণ্টার উপরে। যেতে হবে ফরিদপুর। 
ঢাকা শহরে ওদের সমাহিত করা নিষেধ। অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পারুল পলাশের মাথার কাছে বসলো। আলতো হাতে ভাইয়ের মুখখানায় আদর করলো কিন্তু শেষ স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলতে পারলো না। পুলিশ আগেই মোবাইল নিয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ পলাশ তবুও পুলিশের ভয় কখন যেন জেগে ওঠে। পারুল ভাবতে থাকে এই বজ্র নিনাদ। পুলিশের অত্যাচার। সন্তানহারা মায়ের চিৎকার। স্বৈরাচারের হুংকার। এসব দেখতে পারলে পলাশ হয়তো কবিতা লিখতো : এমন বর্ষা চাই না।

প্যানেল/মো.

×