ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

নান্দনিক শব্দের পুষ্পিত সৌরভে

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

  নান্দনিক শব্দের পুষ্পিত সৌরভে

কবিতা গণিতের মতো। প্রতিদিন প্রাকটিসের আবদার রাখেই। এই প্রাকটিসটা চেতনে, এমনকি অবচেতনেও হতে পারে। তবে একগুঁয়েমি নয়, নিজেকে খোলাসা করে এগোতে হয়। নিজেকে অত ধরা বাঁধায়, কবিতা এগোয় না। এসব কথাগুলো হঠাৎই মনে হলো সম্প্রতি মাহফুজুর রহমান সৌরভের কবিতা পড়তে পড়তে। আরও কত ভাবনাদি বোধে ও মননে জেঁকে বসল সময় নিয়ে কিছুটা লিখতে এসেছি। সেদিন একটা কথা বলেছিÑ প্রেমিকার চেয়ে প্রেমিকার আশপাশ বেশি টানে আমাকে। তখনি আশ্চর্যান্বিত হলাম লেখকরাও সমাজের অন্যদের মতো ভেবে নিল প্রেমিকার বোন, ভাবি, আরও কত নারীর কথা। আসলে আশপাশটা কী? প্রেমিকার আশপাশ মানে প্রকৃতি, পরিবেশ আর ব্যক্তিত্বের সর্বোপরি কথন। আদতে, আমরা অনেক কথাকে একেবারে সাধারণ ভেবে এর মর্মমূলে না গিয়ে ভিন্নতর জায়গায় সারমর্ম নিপতিত করি। সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্বের বিপুল সমাহারও যে থাকতে পারে, সেটাই মনে হয়েছে মাহফুজুর রহমান সৌরভের কবিতাকে। পড়তে পড়তে টেরও পাবেন না, হয়ত ভাবতেও চেষ্টা করছেন না, কী বলতে চাচ্ছে অথচ একটু ভাবলেই পেতে পারতেন নয়া সৌন্দর্যের অবারিত সুবাতাস.... এখনকার কবিতা যখন আড়ালের দাবি রাখে, তখন কবিতার নামে চলছে দুর্বোধ্যতার মতো পরিহাস; এমনকি শব্দের ওপর এক ধরনের নিপীড়ন। কত কষ্ট করে, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে কবিতা বানানোর মহোৎসব চলছে; সেখানে মাহফুজুর রহমান সৌরভের কবিতা আমাকে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। একেবারে নির্ভেজাল সাদামাটা কবিতার গতরে বাইতেনে পুষ্পিত সৌরভ। আড়াল আছে, তবে সে আড়ালের কাব্যিকতা চমকপ্রদ; তদুপরি তেমন ভাবনার প্রয়োজন পড়ে না হয়তো। ধীরস্বভাবে কবিতার পাঁজর বুনে দিতে জানেন মাহফুজুর রহমান সৌরভ। শব্দের ব্যাপারে তেমন পরীক্ষা না থাকলেও কোন শব্দকে বাড়তি বা কোন কারণে কম মনে হয়নি। কখনও কখনও মনে হয়েছে, কবিতাকে এভাবেও ভাবা সম্ভব। আমার বিশ্বাস হয় যে, একেকজনের কবিতা হবে একেকজনের মতো। আমি তা-ই বুঝতে সক্ষম হয়েছি, মাহফুজুর রহমান সৌরভের ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’ পাঠ করে; তন্মধ্য থেকে কয়েকটি কবিতার পঙ্ক্তি আওড়ালে হয়ত বুঝতে সক্ষম হবেন... ক. বালিকার সুগন্ধি বুকের শিশিরে বোধের লুণ্ঠিত শব্দমালার ভ্রুণ গজে উঠবে অনুর্বর কালের জমিনে। — স্বপ্নদাহ ; ১১ পৃ.) খ. তোমার অন্তঃসত্ত্বা বেদনার সন্তাপে দগ্ধ মাটির প্রসব হয় মৃত সন্তান, একি আমার মায়ের ঋণ? নাকি আঁতুর ঘরের ব্যথার জ্বলন্ত ভষ্ম দেহ মাতার গর্ভমূল ছিঁড়ে কাক্সিক্ষত স্বপ্নগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঝরে পড়ে... -আমি এবং সময়ের সম্মুখে;১৬ পৃ.) গ. মাঝ দুপুরে ক্লান্ত রক্তকণিকা অলস শরীরের বিমূর্ত ক্ষতচিহ্ন হতে সপ্তসিন্ধু ভেসে যায় রৌদ্রদাহে ভাঙে বুকের শতাব্দী পাঁজর; -ঝিমিয়ে পড়া অলস দুপুরে ; ১৮ পৃ.) ০২. মাহফুজুর রহমান সৌরভের কবিতা নান্দনিক শব্দের দ্যোতনাময় নানা আঙ্গিক। ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’ গ্রন্থপাঠে কবির শব্দচেতনা বিমোহিত করেছে। কিছু কিছু শব্দ একেবারে কবির নিজস্বতায় কবিতার সঙ্গে এমন দৃঢ় সৃষ্টির রহস্যাবৃত করেছে যে, নান্দনিকতার উচ্ছ্বসিত প্রতিস্থাপন; মাটি-সংলগ্ন চিত্রকল্পের ব্যাপারে আন্তরিকতার বিমূর্ত বাহাস। মাহফুজুর রহমান সৌরভ গীতিকার হিসেবেও যখন সমাদৃত, কবিতাতেও গীতিময়তার ব্যাপারটা বেশ দাপুটে হবে সহজে অনুমেয়। গীতিময়তা কবিতাকে দিয়েছে পাঠের মধ্যে অবারিত আরাম, তৃপ্ততার ওষুধ। এই গীতিময়তার ভেতরে খোদাই করে যায় হাহাকারের সুতীব্র, সুতীক্ষ্ন যন্ত্রণা; মায়ার অন্তর্জালে নিবিড়ে টেনে বুঝিয়ে দেয় আমাদের এখানে ওখানে নানাবিধ অসুখ... ক. কয়েক কিসিম রাতের পর্দা টেনে টেনে ছুঁই ছুঁই ভোরের নাগাল/দেখবে হরিণীর মায়াবী চোখ হতে/আতশবাজির বিচ্ছিন্ন আলো তোমার আগমনে/দীপোৎসব হবে,/তবে সাবধান! এ রাতে কিন্তু ভূতের আছর হয়/কালো ছায়া/কুৎসিত অশরীরী/জারজের আনাগোনা - রাতের প্রচ্ছদ ছিঁড়ে ভোরের অভিষেক ;২০ পৃ.) খ. জোনাক জ্বলা রাতে মধুময়ী নগ্ন চাঁদ পৃথিবী মৈথুনে জল ভাঙে -উপসংহার; ১০৫ পৃ.) গ. আমি আর বিশ্বাসী নই আমার স্বপ্ন- আমার প্রিয় মুখে,/ কি মৃত্যু দেবে আমায়? মৃত্যুর মূলমন্ত্র থেকো তো/আমি জন্মেছি -মৃত্যুতো আমার; ১০৩ পৃ.) ঘ. লাশের স্কেচ আঁকি তুলির খুনসুটিতে এখন আমার ব্যস্ত সময় কাটে/ পরাবাস্তবতায় পৃথিবী এখন লাশের মিউজিয়াম। -লাশের স্কেচ; ৯৬ পৃ.) মাহফুজুর রহমান সৌরভের কবিতা নিয়ে যতকিছু বলি না কেন, শেষ কথায় বলতে হয়- একজন আপাদমস্তক প্রেমের কবি; তারুণ্যদ্বীপ্ত বাক্যস্থিত ভাবনায় অবগাহন... গদ্যছন্দে উন্মাতাল রসাত্মকে মর্মরে বাজে স্মার্ট শব্দগুচ্ছ, নিজস্বতায় ব্যবহার বেশ ভাবিত করে; মাঝে মাঝে থমকে গিয়ে নিজেদের কাছে ফিরতে বাধ্য করে, অনেকে শুধু কবিতা নিয়েও জীবন কাটিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; ভাবতেই ভাললাগে মাহফুজুর রহমানের সৌরভের কবিতা পাঠ করতে করতে। নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে, সেটারও প্রকাশভঙ্গি আরও সুখকর হবে কবির অন্তস্থ কলমে এই কামনা করতেই পারি...
×